ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৩৫ এএম
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বড়ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ছড়ার অনেকটাই এরই মধ্যে দেবে গেছে। ঝুঁকিতে সেতুসহ বেশকিছু স্থাপনা। ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষিতেও। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের শহরশ্রী গ্রামে। প্রবা ফটো
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের শহরশ্রী গ্রামে অবস্থিত বড়ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে জুয়েল মিয়া নামের এক স্থানীয় যুবলীগ নেতাসহ স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে। এতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে এলাকার সাত গ্রামের ২০ থেকে ২৫ হাজার কৃষকের চাষাবাদের জন্য কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্লুইসগেট, সরকারি সেতু এবং চা-বাগানের প্ল্যান্টেশন টিলার অংশবিশেষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে স্লুইসগেটটির পেছন দিকের ছড়া
অনেকটাই দেবে গেছে। পাশের দিনারপুর চা-বাগানের একটি সেকশনের কিছু অংশ চলে গেছে ছড়াগর্ভে।
এ ছাড়া দিনরাত ট্রাক ও ট্রাক্টর দিয়ে বালু পরিবহনের কারণে গ্রামীণ সড়ক ও চা-বাগান এলাকার
সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় বড়ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের
পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করা হলে আদালত ছড়া থেকে বালু উত্তোলনে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা
জারি করেন। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চক্রটি বালু তোলা অব্যাহত রেখেছে।
সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী চক্রের মূল হোতা মির্জাপুর
ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা জুয়েল মিয়ার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইন এবং বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা
আইনে মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এর পরও এলাকায় দাপটের সঙ্গে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে
যাচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে মির্জাপুর ইউনিয়নের শহরশ্রী গ্রামে দেখা
যায়, ওই গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়ছড়ার বিভিন্ন অংশ থেকে বালু তুলে তা বিক্রির
জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছে। গ্রামীণ সড়কে বালু বহনকারী ট্রাক, ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন যানবাহন
চলাচলের কারণে সড়কটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। বড়ছড়ার ওপর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় স্থানীয়
সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্মিত স্লুইসগেটের পেছনের অংশ অনেকটাই দেবে গেছে।
এ ছাড়া দিনারপুর চা-বাগানের একটি টিলার চা প্ল্যান্টেশন, বাগানের সড়ক ও সেতু ঝুঁকির
মুখে পড়েছে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সরকারি স্থাপনার ক্ষতির ব্যাপারে স্থানীয়
কৃষক শফিক মিয়া বলেন, সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা বড়ছড়া স্লুইসগেট আমাদের সাত গ্রামের
প্রাণ। আজ এটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই স্লুইসগেটের পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে
আমাদের এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলিয়ে আমরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করছি।
আওয়ামী লীগের কিছু লোক আমাদের এই ছড়ার মধ্যে বালু তোলার কারণে স্লুইসগেটটি ভেঙে যাচ্ছে।
এলাকার ঘরবাড়ি ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
বড়ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শেখ
সবুজ আলম বলেন, ‘২০০৬-০৭ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ এই এলাকার সাতটি গ্রামের ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের
শুকনো মৌসুমে সেচের পানির উৎস হিসেবে এই বড়ছড়া স্লুইসগেটটি নির্মাণ করে। এতে এলাকার
প্রান্তিক কৃষক সেখানে চাষাবাদ করে থাকেন। অথচ বালু দস্যুদের কারণে আমরা আজ ক্ষতিগ্রস্ত।
২০১৭ সাল থেকে আমরা এই ছড়া থেকে বালু তোলা বন্ধের জন্য সরকারের উচ্চ মহলে লেখালেখি
করে আসছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা আমাদের সেই দাবি আমলে নেয়নি।
আওয়ামী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা দীর্ঘদিন ধরে বালু তুলে যাচ্ছে। আমাদের স্লুইসগেটটি
যেকোনো সময় উল্টে যেতে পারে। এতে ২০ থেকে ২৫ হাজার কৃষক চাষাবাদ করতে পারবে না। তাই
প্রশাসনের কাছে দ্রুত বালু উত্তোলন বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বড়ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মোহাম্মদ মছদ্দর
আলী বলেন, ‘এলজিইডি জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী ২০১৯ সালে অফিস থেকে আমাদের জানায় বালু
উত্তোলন বন্ধ করতে না পারলে স্লুইসগেটটি ভেঙে পড়তে পারে। আপনারা এলাকাবাসী সোচ্চার
হন। কিন্তু বিগত দিনে আওয়ামী লীগের প্রভাবের কারণে আমরা বালু তোলা বন্ধ করতে পারিনি।
যুবলীগ নেতা জুয়েল, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান প্রমুখ এখনও আমাদের হুমকি দেন। তারা আমাদের
সেক্রেটারিকে হুমকি দিয়ে বলেনÑ হাইকোর্টে রিট করায় যদি বালু তোলা বন্ধ হয়, তাহলে ১৬
লাখ টাকা তাকে দেওয়া লাগবে। আমরা এখনও আওয়ামী লীগের বালু দস্যুদের কাছে জিম্মি।’
এ ব্যাপারে মির্জাপুর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা জুয়েল মিয়া বলেন, ‘আমি দুই
বছরের জন্য বড়ছড়া লিজ এনেছি। বড়ছড়া পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি
মো. মছদ্দর আলী আমার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছেন। আমি তাদের ৫০ হাজার টাকা চাঁদা
দিয়েছি। তার পরও আমার লিজ নেওয়া বালুর ঘাট তারা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি একাধিক মামলার
কারণে এখন আত্মগোপনে আছি। আমি কীভাবে বালু উত্তোলন করছি?’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন প্রতিদিনের
বাংলাদেশকে বলেন, ‘বালুর লিজ খনিজ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। আমার কাছে একটা আবেদন
আসছে রিটের একটা ইন্টেরিম অর্ডার (মামলা বিচারাধীন থাকাকালীন আদালতের জারি করা আদেশ)
অ্যাগ্রিমেন্ট কন্টিনিউ না করার কথা বলা হয়েছে। তারা রিটের কপিটা আমাকে দিয়েছেন। আমি
এসিল্যান্ডকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এ ছাড়া বালুমহাল খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় লিজ
দেয়। তাই যারা আবেদন করেছেন তাদের বলেছি আবেদন ও রিটের কপি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে
পাঠাতে।’