রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:১২ পিএম
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:২৬ পিএম
রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া থানা এলাকার আসমাউল হুদা সম্পা পবিত্র ওমরাহ শেষে পরিবার নিয়ে গত ২৫ ডিসেম্বর বাড়ি ফিরেছেন। এরপর দেখতে পান তাদের অবর্তমানে বাড়ির পেছনের জানালার গ্রিল ভেঙে চোর ঢুকে ১৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও দেড় লাখ টাকা নিয়ে গেছে। সেই স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা উদ্ধারে সম্পার পরিবারের সদস্যরা পুলিশের শরণাপন্ন হলেও এখন পর্যন্ত ওই চুরি যাওয়া সম্পদ উদ্ধার হয়নি। শেষ পর্যন্ত তারা শরণাপন্ন হন কবিরাজের। ওই কবিরাজ দাবি করেছেন, চুরি যাওয়া স্বর্ণালঙ্কার চোরেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। কিছু বাকি আছে। সেই স্বর্ণালঙ্কার চোর নিজে থেকেই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে! সম্পা এখন সেই আশাতেই আছেন।
গত ৩০ ডিসেম্বর ভোরে নগরীর চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা আবু তাহের ফজরের নামাজের জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন। এ সময় বাড়ির গেটে ওঁৎ পেতে থাকা ছয় দুর্বৃত্ত তাকে জিম্মি করে বাড়িতে প্রবেশ করে। এরপর আবু তাহেরের স্ত্রী রেহেনা পারভীন শিউলিকে আক্রমণ করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে তাদের ২৬ বছরের চিকিৎসক মেয়ে শাকিরা তাসনিম দোলা ও তার বাবা আবু তাহেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। গুরুতর আহত রেহেনা পারভীন শিউলি রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, তানভীর খান তাজ নামের এক প্রতারক যুবক তার মেয়েকে কয়েক বছর ধরে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। বিষয়টি সম্পর্কে চন্দ্রিমা থানা পুলিশকেও জানানো হয়েছিল।
অপহরণ ও চুরির পাশাপাশি রাজশাহীজুড়ে জমি ও পুকুর দখল বেড়েছে। বিএনপি পরিচয়ে পবা উপজেলার বড়বনগ্রাম মৌজার কচুপাড়া গ্রামের জুলহাস উদ্দিনের তিন বিঘা জমি দখলে নিয়েছে আমজাদ আলী, আজাদ আলী, সাদেরুল, শাকিল, সেলিম, শফি ও ইনসার আলী। গত ৫ আগস্টের পর ভুক্তভোগী জুলহাসকে নওদাপাড়া জিয়া পার্কের সামনে বিএনপির এক নেতার কার্যালয়ে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। সেখানে তাকে বলা হয়, বিএনপি ক্ষমতায় চলে এসেছে। এখন থেকে ওই জমির প্রতি আপনার আর কোনো দাবি নেই। তবে জুলহাস তার সম্পত্তির দলিল দেখাতে চাইলে অভিযুক্তরা তাকে প্রণনাশের হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। গত ২৩ অক্টোবর বেলা ১১টায় অভিযুক্তরা দলবল নিয়ে এসে জমিটি দখল নেয়। পরে জুলহাস আদালতে মামলা করলে আদালত ওই জমির বিষয়ে শাহমখদুম থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তবে ওই অভিযুক্তরা জমি দখলে নিয়ে এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে এবং সেখানে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। থানার পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন ভুক্তভোগী জুলহাস।
রাজনৈতিক দলের নেতারাও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। রাজশাহী মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক (দপ্তর) মো. বজলুল হক মন্টু গত ২১ নভেম্বর দুপুর ২টায় নগরীর ভদ্রা মোড়ের কাছে ছুরিকাঘাতে আহত হন। এরপর তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার হয়ে দলের নেতারা মামলার জন্য বোয়ালিয়া থানায় যান। সেখানে ওসি তাদের জানান, ঘটনাস্থল চন্দ্রিমা থানায়; কাজেই চন্দ্রিমা থানাতেই মামলা করতে হবে। এরপর তারা চন্দ্রিমা থানায় গেলে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ একই কথা বলে তাদের বোয়ালিয়ায় যেতে বলেন। অবশেষে বিএনপির নেতারা এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যার প্রেক্ষিতে ঘটনার এক মাস পর ২৪ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির নেতাদের উপস্থিতিতে বোয়ালিয়া থানার ওসি সেই মামলাটি নিতে বাধ্য হন।
ভুক্তভোগী বিএনপি নেতা মো. বজলুল হক মন্টু বলেন, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের মামলা নিতে যদি পুলিশ এমনটা করে তবে সাধারণ জনগণ কী ধরনের ভোগান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি জানান, মামলা গ্রহণ করা হলেও এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় অভিযুক্ত কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
এর বাইরেও একাধিক এমন অভিযোগ রয়েছে যেসবের অভিযোগ থানায় করা হলেও তার কোনো অগ্রগতি নেই। আবার অনেকে বিপদে পড়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হচ্ছে না। কারণ তারা মনে করছে, অভিযোগ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এমন অবস্থায় রাজশাহীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নাগরিক ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি তার প্রমাণ মেলে খোদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথাবার্তায়ও।
আরএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, বিভিন্ন বাড়িতে চুরি কিছুটা বেড়েছে। তবে আগেও ছিল। এটা ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কোনো বিষয় নয়। অপহরণ, চুরির মতো এমন অপরাধ আগেও হয়েছে। তবে এসব ঘটনা আমাদের কাছে কাম্য নয়। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী ট্রমা কাটিয়ে উঠেছে পুলিশ। পুলিশ কাজ করছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে ওপর জোর দিয়ে তিনি জানান, নগরীতে চার শতাধিক সিকিউরিটি ক্যামেরা ছিল, যা সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সার্ভার রুম থেকে তত্ত্বাবধান করা হতো। ৫ আগস্ট দুষ্কৃতকারীরা ওই ক্যামেরাগুলোর সবকটি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এটার সংস্কার সময়সাপেক্ষ ও অর্থের বিষয় রয়েছে। এটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ওই সিসি ক্যামেরার কারণে একদিকে যেমন অপরাধীদের ধরতে সুবিধা হতো; তেমনি অপরাধীরাও ওই ক্যামরাগুলোর কারণে আতঙ্কে থাকত।
বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় যখন প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। আমাদের পুরো প্রসাসনিক কাঠামো ভেঙে না পড়লেও একটা সংকট দেখা দিয়েছে। যেটার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। প্রচলিত পদ্ধতি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে এমনটা হয় না। যখন একটি দেশে গণঅভ্যুত্থান বা গণতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কোনো পরিবর্তন ঘটে তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়। যা আমরা স্বাধীনতার পরেও দেখেছি। তবে এই পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাও শঙ্কার মধ্যে আছেন। আর এসবের সুযোগ নিচ্ছে কিছু দুষ্কৃতকারীর দল। পুলিশ প্রশাসনের মাঝেও একটি অস্থিরতা কাজ করছে। অস্থায়ী সরকার থাকলে যেসব সমস্যা দেখা দেয় সেটা সর্বক্ষেত্রেই হচ্ছে। সেটা বাজারের দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা সর্বক্ষেত্রেই। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবার আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মানুষের জানমাল রক্ষা সবার আগে। পরিস্থিতি মোবাবিলায় করণীয় নির্ধারণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, থানা বা এসপি অফিসগুলোতে মাসে অন্তত এক দিন গণশুনানির আয়োজন করা উচিত যেখানে রাজনৈতিক দল, ছাত্র প্রতিনিধি ও তৃণমূলের জনগণ তাদের সমস্যা ও সমাধানের কথা বলবেন এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ বেরিয়ে আসতে পারে।