পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
রাসেল মাহমুদ, বরগুনা
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৮ এএম
পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। প্রবা ফটো
‘গত বছর মোর মাইয়াডা অসুস্থ হইয়া পড়ে, ওরে চিকিৎসা করাইতে কিস্তি উঠিতে হয়। কিস্তির টাহা দিয়া বরিশাল নিয়া চিকিৎসা করাতে হয়। আর প্রতি বছর এভাবে ঋণের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত হইয়া পড়ি। গরিব মানুষের জন্য চিকিৎসা নাই, মোরা মরমু চিকিৎসার ছাড়া! মোগো চারদিকে নদী, নেই চিকিৎসার কোনো ভালো ব্যবস্থা। যাগো টাহা আছে হেরা খুলনা, বরিশাল, ঢাকা চিকিৎসা করাইতে যায়। মোরা নাপা খাইয়া ঘরে বইসা থাকি।’ ক্ষোভ নিয়ে এসব বলছিলেন বরাগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানী এলাকার মো. সেলিম।
শুধু সেলিমই না, তার মতো পাথরঘাটা উপজেলার অধিকাংশ বাসিন্দাই মৌলিক অধিকার চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। দেশের দক্ষিণে সাগর তীরবর্তী এ উপজেলায় প্রায় ২ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের চিকিৎসার একমাত্র ভরসার স্থান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকটে ধুঁকছে। লোকবল না থাকার কারণে এখানে অপারেশন থিয়েটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ৫০ শয্যার এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৭ জন চিকৎসক থাকার কথা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ জন চিকিৎসক ছিলেন। তিন বছরের ব্যবধানে এখন চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র একজন। গত ১৮ ডিসেম্বর নতুন করে তিনজন চিকিৎসক যোগদানের অর্ডার হয়েছে। তিন কার্যদিবসে মধ্যে কর্মস্থলে কাজে যোগদান করার কথা থাকলেও তারা এখনও যোগদান করেননি বলে জানা গেছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে অধিকাংশ রোগীকে। পরামর্শ দেওয়া হয় বরিশাল শেরেবাংলা হাসপাতাল বা অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। উপকূলীয় এ উপজেলার অধিকাংশ বাসিন্দার আর্থিক সমস্যার কারণে তা আর সম্ভব হয় না। ফলে তাদের চিকিৎসাসেবার বাইরেই থেকে যেতে হয়।
চিকিৎসা নিতে আসা আন্নি নামে একজন বলেন, ৫ আগস্টের পর সবকিছু পরিবর্তন হলেও আমাদের কপালের কোনো পরিবর্তন নেই। ২ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। তাহলে ভাবুন আমরা কেমন চিকিৎসা পাচ্ছি। এখানে পানির সমস্যা রয়েছে, আর সেই সমস্যায় অনেক শিশু প্রতি বছর আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। অসুস্থ হলে হাজার শিশুকে বরিশাল বা ঢাকা নিয়ে যেতে হয়।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সির অ্যাটেনডেন্স মনজিরুল আলম বলেন, প্রায় ১৭ বছর এখানে কাজ করছি। এখানে অ্যাটেনডেন্স পদের সংখ্যা তিনজন, তবে আছি শুধু আমি একা। ২৪ ঘণ্টা কাজ করি, আমার সহযোগী হিসেবে ওয়ার্ড বয় নিয়ে কাজ চালাই। দৈনিক আউটডোরে ১২০ থেকে ১৫০ জন রোগী আসে।
চিকিৎসকদের চাহিদামতো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এখানে আসতে চান না বলে জানা যায়। বদলির অর্ডার হওয়ার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেখিয়ে চলে যায়। তার স্থলে নতুন করে কাউকে দেওয়া হয় না। আবার কেউ কেউ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বদলি আদেশ বাতিল করে নেন।
সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সংকট থাকায় প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ রোগী ভোগান্তিতে পড়েন। তারা যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকসহ জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা শাহদাত হোসেন বলেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। ২৪ ঘণ্টা ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু রাখতে হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় ডিউটি করে যাচ্ছি। জনবল না থাকার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন প্রদীপ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ করা হলেও জনবল না থাকার কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। যেখানে চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদসংখ্যা ২৭টি। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মাত্র একজন রয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বর নতুন করে তিনজনের বদলির আদেশ হয়েছে। তারা কাজে যোগদান করলে চিকিৎসার মান কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি।