প্রবা প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:২৮ পিএম
রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজারের পাশে সুলভ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে সবজি। প্রবা ফটো
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শাকসবজির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে না এলে নভেম্বর-ডিসেম্বরেও এই দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে আসে না। চলতি বছরে অক্টোবরে প্রায় সব ধরনের সবজির কেজি ১০০ টাকার ওপরে ছিল। কোনো কোনো সবজির দাম ১৪০-১৫০ টাকায় ঠেকেছিল। এ অবস্থায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি আনতে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে দিয়ে কৃষিপণ্যের ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) কার্যক্রম চালু করে। এর মধ্য দিয়ে বিগত আড়াই মাসে বাজারে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।
ক্রেতারা যা বলছেনÑ
সম্প্রতি রাজধানীর পরিবাগ ও মানিকনগর এবং চট্টগ্রাম নগরীতে সরেজমিনে সবজি বিক্রি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরিবাগ এলাকায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, ক্রেতাদের ২০-২৫ জনের একটি জটলা। প্রত্যেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছেন। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। সেখানে কথা হয় ক্রেতা আব্দুল করিম, হাফিজা খাতুন, সাথী আক্তার ও কামাল হোসেনের সঙ্গে। তাদের মধ্যে আব্দুল করিম বলেন, কৃষিপণ্যের এই ওএমএসে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। এদের পণ্য দেওয়ার কৌশলের কারণে অন্যান্য ওএমএস পণ্যের মতো হুড়োহুড়ি নেই। সময়ও কম ব্যয় হচ্ছে। সাথী আক্তার বলেন, অতিথির বাড়িতে আসছিলাম। যাওয়ার পথে সবজি বিক্রির ট্রাক দেখে লাইনে দাঁড়িয়েছি। বেশি সময় লাগেনি। অন্যান্য ওএমএস ট্রাক সেলেও এই কৃষিপণ্যের মতো কৌশল নিলে সময় কম লাগবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এখানে সবজি বিক্রি করছিলেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার অনুসন্ধানকারী মো. মোস্তাক আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা প্রথমে উপস্থিত সবার নাম, মোবাইল নম্বর ও স্বাক্ষর বা আঙুলের ছাপ নিই। তারপর লাইন ধরে টাকা জমা নেওয়ার সময় প্রত্যেকের হাতে আমাদের তৈরি প্লাস্টিকের টোকেন দিই। এটা নিয়ে ট্রাকের কাছে গেলেই পণ্য দেওয়া হয়। দুজন লোক থাকে লাইনে নাম এন্ট্রি করতে। এভাবে কাজ করায় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। সবাই কম সময়ে পণ্য নিয়ে বাসায় ফিরতে পারেন।
মোস্তাক আহমেদ আরও বলেন, প্রত্যেক ট্রাকে ৪০০ জন ক্রেতার জন্য পণ্য থাকে। তাতে এক ডজন ডিম, প্রতি কেজি ৩০ টাকা দরে ৪ কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ, একটি বাঁধাকপি, একটি ফুলকপি, একটি লাউ বা কচুসহ মোট ৬ ধরনের পণ্য দেওয়া হয়। প্রতিটি ট্রাকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি মূল্যের পণ্য থাকে। ট্রাকপ্রতি ৮ জন লোক রাখতে হয়, তাতে গড়ে প্রতিদিন ৫ হাজার ৫০০-৬ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়। পচা বা নষ্ট পণ্যের জন্য সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ঘাটতি দেখানো যায়। তা ছাড়া জেলা পর্যায়ে ৫-৬ জন লোক হলেই চলে। তিনি বলেন, সব সময় কিছু পণ্য থাকে ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। এসব পণ্য এই কর্মসূচির মাধ্যমে কম দামে দেওয়া যেতে পারে।
মানিকনগরে দেখা যায়, কৃষিপণ্য ওএমএসের ট্রাকের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রেতারা। রাশেদ মাহমুদ নামের এক ক্রেতা বলেন, অন্য ওএমএসের চেয়ে সবজি কেনার সিস্টেমটি ভালো। এখানে ধাক্কাধাক্কি নেই। সবাই পণ্য পাচ্ছে। অন্যান্য ওএমএসের লাইনে দাঁড়ালে প্রায় অর্ধেক বেলা নষ্ট হয়ে যায়।
চট্টগ্রামে ১০ পয়েন্টে কম দামে সবজি
চট্টগ্রামে কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় পরিচালিত ট্রাক সেল থেকে সবজি কেনার পর নছুরাবাদ এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘এক দিন পর এক দিন আমাদের এখানে ট্রাক সেলের মাধ্যমে সবজি বিক্রি করা হয়। একজন ক্রেতা ১১০ টাকায় এক ডজন ডিম, ৩০ টাকা করে দুই কেজি আলু, ৭০ টাকায় এক কেজি পেঁয়াজ এবং দুই ধরনের দুই কেজি সবজি কিনতে পারেন।’
চট্টগ্রামের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহরিয়ার আকুঞ্জী বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে আমরা ১০টি পয়েন্টে ট্রাক সেলের মাধ্যমে ডিম, আলু, পেঁয়াজ সবজি বিক্রি করছি। প্রতিটি ট্রাক সেলে ২২০ জন থেকে ২৫০ জন ক্রেতা এসব পণ্য কিনতে পারেন। প্রত্যেকে এক ডজন ডিম, দুই কেজি আলু এবং এক কেজি পেঁয়াজ নিতে পারেন। অন্যদিকে লাউ, কুমড়া, শিম, পটোল, কচুর ছড়া, শসাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি থাকে। এসব সবজির মধ্য থেকে একজন ক্রেতা দুই ধরনের সবজি দুই কেজি নিতে পারেন।
সম্প্রতি নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট এলাকার ট্রাক সেল পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ওইসব এলাকার নিম্নআয়ের বাসিন্দারা লাইন ধরে ট্রাক সেল থেকে ডিম, আলুসহ সবজি কিনছেন। এসব পণ্য কেনার জন্য এক-দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
ওএমএসের ইতিবাচক প্রভাব
কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাকসবজির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এই চড়া দাম কখনও নভেম্বর মাসে গিয়েও ঠেকে। বৃষ্টি, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ সময় বেশি থাকে। এতে করে শাকসবজি ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে আগাম শীতকালীন সবজি বাজারে না এলে দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়।
তারা জানান, ফসলি বছরকে তারা তিন ভাগে ভাগ করেন। তার মধ্যে রয়েছে প্রথমত, খরিপ ১ সিজন, এটি মূলত ১৫ মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, খরিপ ২ সিজন (বর্ষাকাল), যা ১ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর এবং তৃতীয়ত, রবি সিজন, যা ১৬ অক্টোবর থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত। এই তিনটি সিজনের মধ্যে খরিপ ২-এ সবজির দাম নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় ক্রেতাদেরকে।
চলতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে বন্যার কারণে ক্ষেত নষ্ট হয়ে সবজির দাম অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে গত ১৫ অক্টোবর কৃষিপণ্য ওএমএস কর্মসূচি চালু করে সরকার। কার্যক্রমটি গত দুই মাসে বাজারে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন ট্রাক সেলে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, কৃষিপণ্যের ওএমএসে পণ্য নিতে ক্রেতাদের সময় কম ব্যয় হচ্ছে; বাজার দর থেকে ন্যূনতম ২০০-৩০০ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে; বিশৃঙ্খলা হচ্ছে না এবং বাজারে সবজির দাম কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। যদিও নভেম্বরের শেষের দিকে এসে বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম এমনিতেও কমতে শুরু করে।
কৃষিপণ্য ওএমএস কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বাজারগুলোতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। গত ৪ অক্টোবর রাজধানীর বাজারগুলোতে মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হয়েছিল ১০০ থেকে ১৬০ টাকায়, করলার কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০, চিচিঙ্গা কেজি ৮০, কাঁকরোল ৮০ থেকে ১০০, ঝিঙা ৭০ থেকে ৮০, বরবটি ৯০ থেকে ১০০, কাঁচামরিচ ২৮০ থেকে ৩২০, টমেটো ১৬০ থেকে ১৮০, শিম ২৩০ থেকে ২৪০ ও কচুমুখী ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। পেঁয়াজ ১৪০-১৫০ টাকা। বর্তমানে আলুর কেজি ৬০-৬৫ টাকা। তা ছাড়া অন্য সবজিগুলোর দাম কমে এসেছে। চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে। গোল বেগুনের কেজি ৮০, লম্বা বেগুন ৬০, সাদা পটোল ৬০, করলা ও উচ্ছে ৯০-১০০, মুলা ৪০, শসা ৭০ টাকা কেজি। পেঁয়াজ ৭০-৭৫ টাকা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য
যখন ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) মাধ্যমে কৃষিপণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয় তখন দেশের ১৩টি জেলা ৩ বার বন্যায় আক্রান্ত হওয়ায় সবজির ক্ষেতগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে বাজারে দাম বেড়ে গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিম। তিনি বলেন, কার্যক্রমটি মানুষের মধ্যে অনেকটা স্বস্তি এনেছে। তারা কম দামে ভালো পণ্য পাচ্ছে। বিক্রয় কার্যক্রমে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (কয়েকজন আনসার) দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোনো বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম হয়নি। ইতোমধ্যে ৪ লাখ পরিবারের মধ্যে পণ্য বিতরণ করা হয়েছে। বিক্রিতে টোকেন সিস্টেম করায় কেউ লাইন ভেঙে ঢুকতে পারে না।
প্রত্যেক নাগরিককে একটি করে স্মার্ট কার্ড দেওয়া যায় কি না সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কৃষিপণ্য কেনার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে এমন নিয়ম আছে। এতে করে প্রত্যেকেই খুব সহজে পণ্য পাবে। সরকার যে ভর্তুকি দেয় সেই মূল্যে বিভিন্ন দোকান থেকে পণ্য নিতে পারবে।
দীর্ঘস্থায়ী মডেল তৈরির প্রস্তাব রয়েছে জানিয়ে মাসুদ করিম বলেন, কৃষিপণ্যের ওএমএস কর্মসূচিকে দীর্ঘস্থায়ী একটি মডেলে দাঁড় করানো নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। কার্যক্রমটি প্রতি বছর ও মৌসুমভিত্তিক চালু থাকলে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে নতুন করে উদ্যোগ নেয় তবে কৃষক ও ক্রেতা উভয়ের জন্য ভালো হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার গত অর্থবছরে কৃষি উপকরণে (সার, বীজ, সেচ ইত্যাদি) ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আর কৃষিপণ্য ওএমএসে ভর্তুকির পরিমাণ হচ্ছে ৭ কোটি টাকা। আগামীতে এই খাতে ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া গেলে সারা দেশেই কৃষিপণ্য বিক্রি করে ক্রেতাদের মধ্যে স্বস্তি নিয়ে আসা সম্ভব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, খরিপ-২ মৌসুমে বৃষ্টিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এতে বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। সবজির দাম হু হু করে বেড়ে যায়। আমাদের পারিবারিক পুষ্টি বাগান নামে একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি পতিত জমি, বাড়ির আঙ্গিনায় সবজির আবাদ বাড়াতে। কৃষকরা ভালো জাতের বীজ সংগ্রহ করতে পারলে ঘরের চালে বা বাড়ির আঙ্গিনায় ভালো ফলন হবে।