সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা
সুনামগঞ্জ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৪১ পিএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৪৩ পিএম
ফেসবুক পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে কমেন্টের জেরে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মোঙলারগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এলাকার অনেকে বলছেন, হামলাকারীরা যেরকম মারমুখী ছিল তাতে বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা ছিল। এলাকার আলেম-ওলামা, রাজনৈতিক কর্মী, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টায় হাজারো উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়।
দোয়ারাবাজার কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর ফেসবুকের কমেন্টসকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত এই উত্তেজনা ছিল। অভিযুক্ত তরুণ আকাশ দাসকে গতকাল বুধবার বিকালে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক তাকে জেল-হাজতে পাঠান। তবে তার গ্রাম মোঙলারগাঁওয়ে এখনও সবাই বাড়িতে ফেরেননি। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে গ্রামে।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টায় মোঙলারগাঁও গ্রামের হিন্দুহাটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকের ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। কিছু পুরুষ মানুষ বাড়ি ফিরলেও পরিবারের নারী সদস্যরা আশপাশের গ্রামের স্বজনদের বাড়িতেই রয়েছেন। গ্রামে হিন্দু পরিবার ৯৫টি। এর মধ্যে ২৫টি পরিবারের নারীরা ওই সময় পর্যন্ত (বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত) বাড়ি ফেরেননি। আশপাশের গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের গণ্যমান্যরা এসে তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছিলেন।
নৈনগাঁও মহিলা মাদ্রাসার মুহতামিম আব্দুল করিম বলেন, ক্ষুব্ধ হাজার হাজার মানুষ দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরে জড়ো হয়েছিলেন। এই পথ দিয়ে আসার সময় মানুষজনকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েই ফেরানোর চেষ্টা করেছি আমরা। পথ আগলে দাঁড়িয়েছি, বলেছি মুসলমানরাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে হবে, ইসলাম এসব হামলা-মারপিট সমর্থন করে না। পরে সবাই সায় দিয়েছেন, বেশিরভাগই ফিরে গেছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
নৈনগাঁওয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আব্দুল খালিক ও তার ছেলে ভাতিজারা কীভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন ব্যাখ্যা করে বললেন, যত মানুষ গ্রামে ঢুকেছে, সেই তুলনায় গ্রামের ঘরবাড়ির তেমন ক্ষতি হয়নি। আমাদের অনেক ছেলে পথে পথে দাঁড়িয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেছে।
আকাশ দাসের বাবা প্রফুল্ল দাস প্রবাসে আছেন ২৫ বছর। স্ত্রী জ্যোৎস্না দাস ভোরে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে আছেন। কেউ ডাকলেও খুলছেন না। এজন্য এই ঘরের ভেতরে কী অবস্থা হয়েছে দেখা যায়নি। প্রতিবেশী মানিক লাল দাস বললেন, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আধা কিলোমিটার দূরের জঙ্গলে ছিলাম। পরে টেবলাইয়ের এক বাড়িতে গিয়ে উঠেছি। স্ত্রী ও মেয়ে ওখানেই আছে। আমার ঘরে এমন কিছু নেই, যা ভাঙা হয়নি। পাশের ঘরের দিগেন্দ্র দাসও এভাবেই বর্ণনা দিলেন।
গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, হামলাকারী জনতা ৫০-৬০টি বাড়িতে গেলেও কাজল দাস, মানিক লাল দাস, হরিধন দাস, সতন দাস, সুবোধ দাস, অশেষ দাস, বাবুল দাস, মতিন্দ্র সূত্রধর ও পিন্টু দাসের ঘরে ঢুকেছে।
অন্তঃসত্ত্বা রুমি রানী দাস দৌড়ে পালাতে গিয়ে আহত হন। তাকে রাতেই পরিবারের লোকজন সিলেটে নিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রেও এলাকাবাসী সহায়তা করেছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা যেসব ঘরে ঢুকেছে ওই পরিবারগুলোর মধ্যে দুটি পরিবারের পারিবারিক দেব মণ্ডপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করেছেন গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন।
ঘটনার পরপর রাতেই সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া, পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম, সেনাবাহিনীর সুনামগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল নাফিজ ইমতিয়াজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। গভীর রাত পর্যন্ত ওখানে থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দিয়েছেন তারা। বুধবার বিকালে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মুশফেকুর রহমান দোয়ারাবাজার যান।
দোয়ারাবাজার থানার ওসি জাহিদুল হক জানিয়েছেন আকাশ দাসের বিরুদ্ধে দোয়ারাবাজার থানার সাব-ইন্সপেক্টর আরাফাত ইবনে শফিউল্লা বাদী হয়ে মামলা (সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২৮/২, ৩২/২, ৩৩/২, দণ্ডবিধির ১৫৩, ৫০৪ ও ৫০৫-খ) করেছেন।