× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বড়শির সুতোয় গাঁথা জীবন

সাইদুল ইসলাম মন্টু, বেতাগী (বরগুনা)

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৭ পিএম

ডিঙি নৌকায় ভেসে বড়শি দিয়ে চলছে মাছ শিকার। সম্প্রতি উপজেলার বিষখালী নদীর কালিবাড়ী এলাকায়

ডিঙি নৌকায় ভেসে বড়শি দিয়ে চলছে মাছ শিকার। সম্প্রতি উপজেলার বিষখালী নদীর কালিবাড়ী এলাকায়

দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনা। এ জেলার বেতাগী পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সোহরাব হাওলাদার ডিঙি নৌকায় ভেসে বিষখালী নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন। এটাই তার পেশা। শুধু সোহরাবই নন, তার মতো এমন অনেকেই আছে, যাদের সংসার চলে মাছ শিকার করে। বলা যায় মাছ শিকারই তাদের জীবন-জীবিকা। বছরজুড়ে মাছ ধরে তা বিক্রি করে চলে তাদের সংসার। এর বাইরে অন্য কোনো কাজ নেই তাদের। 

নৌকায় চড়ে নিয়মিত মাছ শিকার করা সোহরাব হাওলাদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বড়শিতে মাছ শিকার করেই চলে সংসার। আমার মতো অনেকেই আছে এ পেশায়। জীবিকার প্রয়োজনে দিন-রাত মাছ শিকার করি। এটাই আমার পেশা-নেশা। মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চলে। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাও করাচ্ছি। 

তার সঙ্গে কথার মধ্যই এগিয়ে আসেন আরেক মৎস্যশিকারি লাবলু মিঞা। মধ্যবয়সি লাবলু মিঞা বলেন, বছরের এই সময়টা আসলে মাছ শিকারের জন্য। এ সময় অন্য পেশার লোকজনও শামিল হয় মাছ ধরায়। কেউ কেউ আবার নিজে খাওয়ার জন্যও শখের বশে মাছ ধরে। 

উপার্জনের অন্য কোনো উপায় না থাকায় এ উপজেলায় বড়শির সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে সোহরাব, লাবলুর মতো সাতশতাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকা।

সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার বিবিচিনির বাড়ই খাল, বিবিচিনি খেয়াঘাট, ফুলতলা খাল, গাবুয়া খাল, ছোট ঝোপখালী, কেওয়াবুনিয়া, বেতাগী খাল, কেওড়াবুনিয়া, ঝিলবুনিয়া, ছোট মোকামিয়া খাল, মোকামিয়া লঞ্চঘাট, বেতাগী খালের স্লুইসগেট এলাকা, ফুলতলা, কাঁঠালতলী, চরখালী, কইনার খাল, কাইয়ালঘাটা, গ্রামার্দ্দন খাল, ছোট বদনীখালী, বলাইবুনিয়া, তালবাড়ি, কালিকাবাড়ি, দক্ষিণ কালিকাবাড়ি, জোমাদ্দার বাড়ির হোতা, নিবারণ বয়াতি এলাকা, আলীয়াবাদ, রাণীর খাল, গাবতলী খাল, ভোড়া খাল ও ফুলঝুড়ির মতো স্থানীয় খাল, বিষখালী নদী এবং বেড়েরদোন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকার করে সংসার চলে কয়েকশ ব্যক্তি ও পরিবারের।

শুধু বড়রাই নয়, তাদের সঙ্গে কখনও কখনও যোগ দেন পরিবারের শিশুসদস্যরাও। বেতাগী পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের এমনই দুই শিশু রাফসান (১৫) ও সিয়াম (১০)। তারা জানায়, সবার দেখাদেখি নেমেছি। মাঝেমধ্যে বড়শিতে বেশ মাছ পাই। বেশিরভাগ সময়ই চিড়িং মাছ ধরা পড়ে। 

স্থানীয় জেলেরা জানান, কয়েক বছর আগেও এখানকার খাল-বিল ও নদ-নদীতে পাঙাস, চিতল, রিটা, কাউন, পোয়া, আইড়, পাবদা, সরপুঁটি ও কোরালের মতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে গলদা চিড়িং ছাড়া ওইসব মাছের দেখা কমই মেলে।

স্থানীয় মাছ শিকারিরা জানান, তিথির পরিবর্তনে নদীর জোয়ার-ভাটার ধরনে বড়শিতে মাছ শিকারের কৌশলেরও পরিবর্তন করেন তারা। অবশ্য বর্ষায় বোয়াল, আইড়, কোরাল মাছ ধরা পড়ে। বড়শির আকার ও সুতার ধরনও থাকে ভিন্ন। আবার কার্তিক, পৌষ, মাঘ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত গলদা চিংড়ি, পোয়া, রিটা, গাঁগড়া ধরা পড়ায় এ সময় অনেকেই ডিঙি নৌকায় ভেসে ছিপ ফেলেন নদীতে। তারা বড়শির টোপে লালশো বা গেছো লাল পিঁপড়ের ডিম, অ্যাকাঙ্গি, মহুয়া ফুল, পুরোনো মধু, মিষ্টির বাসি রস, আটাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা ব্যবহার করে মাছ শিকার করেন। গলদা চিংড়ি ধরতে কেঁচোই ব্যবহার করেন অনেকে। তবে সময়ের পরিবর্তনে মাছ ধরার কৌশল পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন নেই তাদের জীবন-মানের। আজীবন বড়শিতেই বাঁধা এদের জীবন-সংসার। 

স্থানীদের সঙ্গে বিষখালী নদীর একাধিক পয়েন্টে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন বামনা, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর, বাকেরগঞ্জ উপজেলার অনেকে। কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া গ্রামের সাহারুল খান (৬৫) ও মিলন দাস (৫০)। তারা জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে বড়শিতে মাছ শিকার করছেন তারা। মাছ শিকার করেই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চলে তাদের। জমিজমা না থাকায় ছোট থেকেই এই পেশায় জড়িয়ে আছেন তারা।

বেতাগী সরকারি কলেজে পড়ে ছেলে কামরুল হাসান। লেখাপড়ার খরচ চলে বড়শিতে মাছ শিকারের টাকায়। বাবা আলতাফ হোসেন লেখাপড়া না জানলেও মাছ শিকারে ওস্তাদ। অনেকে প্রায়ই খালি হাতে ফিরলেও তার ডোল মাছে ভরে যায়। মাছ শিকার শেষে তা শহরে বিক্রি করেন। দৈনিক আয় তার ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা। কখনও আবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ৭-৮ হাজার টাকাও আয় করেন তিনি। 

ডিঙি নৌকায় চড়ে বড়শিতে মাছ শিকারে এসেছেন কাজিরাবাদ ইউনিয়নের আব্দুর রাজ্জাক (৪৬) ও তার দুই ছেলে। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সবকিছু বদলে যাচ্ছে। চর জেগে নদী-খাল ভরাট হচ্ছে। আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও জীবিকার তাগিদে মাছ ধরি। জমি-জিরাত নেই। কষ্ট করে রাত জেগে নদীতে ভেসে মাছ শিকার করছি।

বিষখালী নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা ছৈলার চরের শাখা খালে নৌকা নোঙর করা পঞ্চাশোর্ধ্ব আব্দুর রহিম। তিনি জানান, পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। বড়শিতে মাছ শিকারই তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু আগের সব মাছ যেন হারিয়ে গেছে। এখন আর নদী-খালে মাছ তেমন দেখা যায় না।

আবহাওয়া পরিবর্তন, রেণু নিধন, মা ইলিশ শিকার, নদী ভরাট, নিষিদ্ধজাল ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীতে মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। শিকারির বড়শিতেও আর মিলছে না তেমন মাছ। কাটছে দুর্বিষহ জীবন। এমনটাই জানালেন এসব মাছ শিকারী। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা