রায়হান আলী, ভাঙ্গুড়া (পাবনা)
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ২০:০৮ পিএম
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:২৫ এএম
পলো, জালসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ নিয়ে মাছ ধরতে ছুটে এসেছে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা। বাউৎ উৎসবে শনিবার পাবনার ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিল থেকে তোলা।
পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা এবারও মেতেছে চলনবিলের বাউৎ উৎসবে। বিলের নানা প্রজাতির মাছ শিকার যেন বাউৎ উৎসবে পরিণত হয়। শনিবার (৩০ নভেম্বর) ভোরে চোখে পড়ে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার রুহুল বিলে এমন দৃশ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে কাকডাকা ভোরে কারও হাতে পলো, কারও হাতে খেয়া জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। দলবেঁধে বিলে নেমে মনের আনন্দে মাছ শিকার শুরু করে। কেউ পাচ্ছে বোয়াল, কেউবা শোল, রুই, কাতল। আবার খালি হাতেও ফিরছে কেউ কেউ। এভাবেই চলনবিলে মাছ শিকারে মেতেছে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা।
স্থানীয়রা জানায়, ভাঙ্গুড়ার রুহুল বিলে দলবেঁধে মাছ ধরার এই আয়োজনের নাম ‘বাউৎ উৎসব’। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউৎ উৎসবে অংশ নেয় নানা বয়সি হাজারো মানুষ। তবে এ বছর বিলে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছের দেখা। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ মৎস্য শিকারিরা। তাদের অভিযোগ, অবৈধ জাল আর গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছ ধরে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। ফলে মাছ ও পোকামাকড় মরে গিয়ে পানিতে সৃষ্টি হয়েছে দুর্গন্ধ।
পাবনা-ফরিদপুর আঞ্চলিক সড়কের ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পাটুলিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অন্তত ২০টি বাস। এসব বাসে কুষ্টিয়া, নাটোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছে অনেক মৎস্য শিকারি। আবার অনেকে ইজিবাইক, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসেছে। এরপর রুহুল বিল অভিমুখে ছুটে চলে মানুষ। ভোরের আলো ফোটার আগেই বিলপাড়ে হাজির নানা বয়সি হাজারো মানুষ। সবার হাতে পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। একসঙ্গে বিলে নেমে লোকজ রীতিতে মনের আনন্দে চলছে মাছ শিকার। দলবেঁধে মাছ ধরার এ আয়োজনে মৎস্য শিকারিদের ডাকা হয় বাউৎ। তাদের ঘিরেই উৎসবের নামকরণ। চলনবিলাঞ্চলে এমন উৎসব চলছে যুগের পর যুগ।
স্থানীয় ও মৎস্য শিকারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে মাসব্যাপী চলে এই উৎসব। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে বিলাঞ্চলের পূর্বনির্ধারিত এলাকায় দলবেঁধে মাছ শিকারে নামে বাউৎপ্রেমীরা। চলনবিলের রুহুল বিল, ডিকশির বিল, রামের বিলসহ বিভিন্ন বিলে মাসব্যাপী চলে এই বাউৎ উৎসব। বিভিন্ন বয়সি মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। কে মাছ পেল, কে পেল না তা নিয়ে হতাশা নেই। তাদের কাছে আনন্দটাই বড় কথা।
সিরাজগঞ্জ থেকে মাছ শিকারে আসা নয়ন আলী বলেন, ‘বাউৎ উৎসবের কথা অনেক শুনেছি। এবার সিরাজগঞ্জ থেকে ছয়টি বাস নিয়ে দুই শতাধিক লোক এসেছি মাছ ধরতে। এত লোক একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। খুব ভালো লেগেছে।’
নাটোর থেকে আসা আরেক মৎস্য শিকারি আব্দুল মালেক বলেন, ‘প্রতিবছরই আসি এই বাউৎ উৎসবে। কিন্তু এবার মাছ নেই বললেই চলে। তবে আমরা মাছ পাই বা না পাই, সবাই মিলে আনন্দ করি এটাই ভালো লাগে।’
ফরিদপুর উপজেলার মাছ শিকারি আজাহার আলী বলেন, ‘প্রভাবশালীরা আগেই চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল দিয়ে সব মাছ মাইরে লিছে। পরে তারা বিলে গ্যাস ট্যাবলেট দিছে, যে কারণে ছোটখাটো মাছ যা আছে বেশিরভাগ মরে গেছে। পানিতেও দুর্গন্ধ ম্যালা। এজন্যি মাছ নাই ইবার।’
বাউৎ উৎসব দেখতে আসা আশিকুর রহমান, নায়েব ইসলাম, ফিরোজ হোসেন, জুয়েল আহমেদসহ কয়েকজন বলেন, বিলে যেভাবে গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে তাতে দেশি মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে অবৈধ চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জাল ব্যবহার হচ্ছে। এখনই প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হলে আগামী দিনে দেশি মাছের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির এই উৎসবও হারিয়ে যাবে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, ‘মাছের প্রজনন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে বাউৎ উৎসব পালন করতে হবে। মৎস্য শিকারিদের সচেতন হতে হবে। বিলে গ্যাস ট্যাবলেট বা অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছের ও পরিবেশের ক্ষতির অভিযোগ পেলে মৎস্য আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’