× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজশাহীর চারঘাট

ড্রাইভার থেকে চেয়ারম্যান মধুর দুর্নীতির যত ‘কীর্তি’

শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)

প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৮ এএম

হাসানুজ্জামান মধু। ছবি: সংগৃহীত

হাসানুজ্জামান মধু। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা হাসানুজ্জামান মধু। একসময় ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান তপনের মোটরসাইকেলের ড্রাইভার। তবে রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর বদলে যায় তার অবস্থা ও আচরণ। ক্ষমতার দাপটে হয়ে ওঠেন গোটা উপজেলার ত্রাস। হাট-বাজার ও জমি দখল, চাঁদাবাজি, সালিশ ও নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশনে মাদক ব্যবসাসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় সরাসরি থাকার অভিযোগসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি হাসানুজ্জামান মধু গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাসানুজ্জামান মধু তিন নম্বর সরদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো উঠে এসেছে ওই এলাকার ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে।

কয়েক মাস আগে উপজেলার মুংলী কারিগরপাড়া গ্রামের মিঠুনের মেয়ে মুংলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মায়েশা আক্তার নিজ বাড়ি থেকে মুংলী বাজারে কোচিং করতে যাচ্ছিল। এমন সময়ে বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় সে মারা যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অটোটি জব্দ করলেও পালিয়ে যায় অটোচালক। এ বিষয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। এর পরে চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মধু একটি মীমাংসার সালিশে অটোচালককে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে আদায় করেন। মৃত মায়েশার বাবা মিঠুনকে মাত্র ৭৫ হাজার টাকা দেন।

মিঠুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মধু চেয়ারম্যান সালিশের ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে মাত্র ৭৫ হাজার টাকা দেন। বাকি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা তার কাছে রেখে দেন। চেয়ারম্যানের কাছে বারবার গেলেও টাকা দেননি, বিভিন্ন দিন ঘুরিয়েছেন।’

উপজেলার ঝিকরা গ্রামের নিখিল হালদার বলেন, ‘আমি একটি পুকুর খনন শুরু করলে মধু চেয়ারম্যান তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে এসে আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা নেন। কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার চাঁদা চান, চাঁদা দিতে আমি অপারগতা প্রকাশ করলে পুকুর খনন বন্ধ করে দেন। পরে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে মাত্র সাড়ে চার লাখ টাকায় চেয়ারম্যানের ভায়রার ছেলের কাছে ইস্টেম করে নেই, আমার ১২ লাখ টাকা ইনভেস্ট করা পুকুর মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টাকায় জোর করে নিয়ে নেন। আর সাড়ে চার লাখ টাকার মধ্যে শুধু আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। চেয়ারম্যানের কাছে বারবার টাকার কথা বললে তিনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে হুমকি দিতেন।’

আরেক বৃদ্ধ গিয়াস মুন্না বলেন, ‘আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে সালিশ করেন মধু চেয়ারম্যান। সালিশে ছেলেপক্ষের ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তারা সেগুলো দিলেও চেয়ারম্যান টাকাগুলো সব মেরে খেয়েছে। বারবার চেয়েও সে টাকা আমি পাইনি।’

খোর্দগোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু দিন আগে আমাদের স্কুলে কম্পিউটার ল্যাবে চুরি হয়, কয়েক দিন পর বিদ্যালয়ে চুরি হওয়া জিনিসপত্র ফিরে পাই। হাসানুজ্জামান মধু চেয়ারম্যান তার বাড়িতে রাতে সালিশ করে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন, কিন্তু সেই সালিশে বিদ্যালয়ের কেউ উপস্থিত ছিলেন না এবং জরিমানার টাকাও আমরা নিইনি।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের মতিউর বলেন, ‘আমার ৪ বিঘা জমি মধু চেয়ারম্যান উপস্থিত থেকে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল করে নেন। আমি বাধা দিতে গেলে আমার পরিবারকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা ও মামলার হুমকি দেন। তার এই সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে পুরো উপজেলাবাসী অতিষ্ঠ হয়েছিল। মধু চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমরা এলাকাবাসী খুব ক্ষুব্ধ।’

ঝিকরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুল হক বলেন, ‘হাসানুজ্জামান মধু চেয়ারম্যান আমার প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন, আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে নিয়োগ প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিলেন এবং তিনজনকে নিয়োগ দিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। চেয়ারম্যানকে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কোনো কাজ করতে বললেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন, আমি তাকে ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।’

হাসানুজ্জামান মধু চেয়ারম্যানের বিশ্বস্ত কাছের মানুষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইউনিয়নের চারটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৫ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রায় কোটি টাকা নিয়েছেন এবং অনেকজনের কাছ থেকে চাকরি দেবে বলে টাকা নিয়েছেন চেয়ারম্যান।’

একই গ্রামের বাসিন্দা চারঘাট উপজেলার বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর শাহ বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালে রাতের আঁধারে ভোট চুরি করে অবৈধভাবে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ দখল করেন হাসানুজ্জামান মধু। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ধরে সরদহ ইউনিয়নে দখলদারত্বসহ সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করেছেন। দুর্নীতি করে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। এ ভোট চোর চেয়ারম্যান বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও মামলা দিয়ে বাড়িতে থাকতে দেননি। এ চেয়ারম্যানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সরদহ ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ। এক দশকেরও বেশি সময় এই মধু চেয়ারম্যান ও তার গুণ্ডা বাহিনীর অত্যাচারে আমরা বিএনপি ও ভিন্নমতের লোক এলাকায় থাকতে পারিনি। সাধারণ মানুষকেও তারা ছাড়েনি। যে তাদের অন্যায়কে সমর্থন করেনি তাকেই হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে।’

সরদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মধু চেয়ারম্যান আমার মেয়ের চাকরি দেবেন বলে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন, কিন্তু চাকরি দেননি। আমি তার বাসায় দীর্ঘদিন টাকা ফেরত চাইতে গেলে আমাকে বিভিন্ন হুমকি দিতেন, ২০১৮ সালে আমাকে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন করেন, অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার পাশে আমাকে ফেলে চলে যায়, আমি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে থানায় মামলা দিতে গেলে তার ভয়ে থানা মামলা নেয়নি।’

৩ নম্বর সরদহ ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য সাইদুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারম্যান ক্ষমতার দাপটে কোনো দিন পরিষদে সদস্যদের নিয়ে সভায় বসেননি। কোন প্রকল্প থেকে কত টাকা বরাদ্দ এসেছে তা জানতে পারিনি। তিনি একাই আত্মসাৎ করেছেন। আর আমাদের ইউপি পরিষদে কোনো সালিশ হয় না, চেয়ারম্যানের বাড়িতে রাতে সালিশ হতো।’

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চারঘাট উপজেলার সমন্বয়ক শাকিব বলেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এই মধু চেয়ারম্যান তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, আমার পাঁচ ভাইকে বেধড়ক পিটিয়ে মামলা দেয়। আমরা আশা করি, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনবে।’

গত ৫ আগস্টের পর মধু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এর পর থেকেই পলাতক রয়েছেন তিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

চারঘাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন বলেন, ‘চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে অভিযান চালানো হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণের শান্তি বজায় রাখতে এবং তদন্তে সহযোগিতা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা