রাজশাহীর চারঘাট
শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:০৭ পিএম
কৃষকের আখ পরিপক্ক হয়ে হেলে পড়ছে। চাষি জমিতে তা বেঁধে রাখার চেষ্টা করছেন। বুধবার রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ঝিকরা গ্রামে। প্রবা ফটো
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মাড়াইকল দিয়ে আখ মাড়াই ও গুড় প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে কৃষকদের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করে জেলা প্রশাসন। এদিকে চিনিকলের আখ সংগ্রহ অভিযান দেরিতে শুরু হওয়ায় কৃষকের পরিপক্ব আখ জমিতেই দাঁড়িয়ে আছে। আখ কেটে রবি মৌসুমের আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করতে পারছে না রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কৃষক। এ নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
রাজশাহী চিনিকলের কর্মকর্তারা বলছেন, আজ ২৮ নভেম্বর থেকে আখ সংগ্রহ শুরু করা হবে। মাসখানেকের মধ্যেই হয়তো সংগ্রহ অভিযান শেষ হবে। তাতে শীতকালীন আবাদের তেমন ক্ষতি হবে না। কেউ যাতে মাড়াইকল স্থাপন করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর তদারকি করছেন তারা। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকায় গুড় উৎপাদন ও পরিবহনেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে গুড় উৎপাদন তদারকির দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বলে জানান তারা।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে চারঘাটের বিভিন্ন আখক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ আখ পরিপক্ব হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। কোথাও আবার দীর্ঘদিন জমিতে থাকায় মাথা শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা প্রতিদিনই আখের জমি দেখাশোনা করছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অপরদিকে ভোররাত থেকে ভ্যান, নছিমন ও মিনিট্রাকে করে শত শত মণ গুড় এসব এলাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। দিন-রাত সমানতালে কারখানায় ভেজাল গুড় তৈরি করা হচ্ছে। কৃষকের থেসার মেশিন স্থাপনের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও ভেজাল গুড় তৈরির বিষয়ে কোনো অভিযান নেই।
উপজেলার ঝিকরা এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, দেড় বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছি। সার, কীটনাশক মিলে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আখ এখন বিক্রি করতে পারলে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা দাম পেতাম। কিন্তু চিনিকল আখ সংগ্রহ শুরু করলেও আগে বড় চাষিদের আখ নেয়। তারপর নেয় ছোট চাষিদের আখ। ততদিনে আখ শুকিয়ে ওজন অর্ধেক হয়ে যাবে। এক বছর জমিতে রেখেও আখ চাষে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। অথচ সবজি কিংবা অন্য কোনো ফসল চাষ করলে অন্তত এক লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারতাম।
এদিকে উপজলার বিভিন্ন আখের গুড় তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, গভীর রাতে থেসার মেশিনে আখ মাড়াই করে আখের রস ব্যারালে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেই রস গুড় তৈরির বড় কড়াইয়ে জ্বাল করা হচ্ছে। কিছুটা ঘন হলে রসের ভেতরে ভারতীয় টিনের প্যাকেটে আসা চিটাগুড়, চিনি, আটা, হাইড্রোজ ও কাপড়ের রঙ ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে আখের গুড়। আখ মাড়াই বন্ধ থাকায় বাজারে এসব গুড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় চিটাগুড় সরবরাহ করতে ভারত থেকে আসা গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত চিটাগুড়ের পাইকারি দোকান গড়ে উঠছে চারঘাটের কাঁকাড়ামারী, পরানপুর, বাঁকড়া ও রামচন্দ্রপুর এলাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চারঘাটের গঁওরা এলাকার এক আখের গুড়ের কারখানা মালিক বলেন, মূলত যারা গরুর খাবার হিসেবে চিটাগুড় আমদানি করছেন তারাই এ ভেজাল কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা বাকিতে চিটাগুড় দেন। আমরা ছোট কৃষকদের কাছ থেকে আখ কিনে মাড়াই করে রসের সঙ্গে চিটাগুড় ও আরও কিছু রাসায়নিকের সঙ্গে মিশিয়ে গুড় তৈরি করি। সেই গুড়ও বিক্রির ব্যবস্থা করেন চিটাগুড় আমদানিকারকরা। অন্যায় জেনেও লাভের আশায় অনেকে এটা করলেও সিংহভাগ লাভ যাচ্ছে আমদানিকারক সিন্ডিকেটের পকেটে।
চারঘাট সাবজোন প্রধান রুস্তম আলী বলেন, চিনিকল না বাঁচলে কৃষক, দেশ ও আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। কৃষকের লাভের কথা ভেবে আখের দামও বাড়ানো হয়েছে। কৃষকের আখের দাম সঠিক সময়ে পরিশোধেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য আখ মাড়াই, গুড় তৈরি ও গুড় পরিবহন সবকিছুতেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে থেসার মেশিন স্থাপনে কৃষকদের আমরা নিরুৎসাহিত করছি। তবে এর মধ্যেও ভারতীয় টিনের গুড় দিয়ে একটি চক্র গুড় তৈরি করছে। তবে এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার দপ্তর অভিযান পরিচালনা করে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রাজশাহী জেলার সহকারী পরিচালক মাসুম আলী বলেন, নির্দিষ্টভাবে কেবল আখের গুড় নিয়ে অভিযান হচ্ছে না। যেকোনো ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। ইতোমধ্যে চারঘাট-বাঘা এলাকায় একাধিকবার অভিযান চালিয়ে ভেজাল গুড় তৈরির দায়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ অভিযান আগামীতেও চলমান থাকবে।