× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

চরমাদ্রাজ ফাজিল মাদ্রাসা

অনিয়মের ‘সব রেকর্ড’ ভঙ্গ নিজাম উদ্দিনের

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪৬ এএম

আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৪ এএম

নিজাম উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

নিজাম উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

অনিয়মের সব রেকর্ড ভেঙে চরমাদ্রাজ ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হয়েছেন নিজাম উদ্দিন। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কৃষি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাও নেই তার। জাল সনদ, ভুয়া নথিপত্র, কর্মকর্তাদের নকল স্বাক্ষর এবং শিক্ষক ইনডেক্স নম্বরের অপব্যবহার করে অধ্যক্ষের পদ দখলে নিয়েছেন তিনি। এমনকি জীবিত অধ্যক্ষকে মৃত দেখিয়ে পদটি দখল করেছেন। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন এ ভুয়া অধ্যক্ষ। নিজের তৈরি বক্র পথে আরও অন্তত দুজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত এবং বিশদ অনুসন্ধানে তার জালিয়াতির এসব তথ্য উঠে এসেছে।

জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরমাদ্রাজ ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন (হুমায়ুন সরমান) যথাযথ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এ পদ দখলে নেন। অভূতপূর্ব জাল-জালিয়াতি এবং পেশিশক্তির বলে তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হয়েছেন। অথচ কৃষি শিক্ষক হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই তার।

নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডিপ্লোমা ছাড়াই ‍জালিয়াতির মাধ্যমে প্রথমে হন কৃষি শিক্ষক। এর পর শিক্ষক নিবন্ধন সনদ না থাকা সত্ত্বেও হয়েছেন প্রভাষক। এখানেই ক্ষান্ত থাকেননি নির্ধারিত বয়সসীমা লঙ্ঘন করে হয়েছেন অধ্যক্ষ। এ পদে বসতে দায়িত্বরত জীবিত অধ্যক্ষকে দেখান মৃত। এমনকি পরিচালনা কমিটির ভুয়া রেজল্যুশন তৈরি করে সভাপতির স্বাক্ষর জাল করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ দখলে নেন। অর্থাৎ অধ্যক্ষ হওয়ার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেননি তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অধ্যক্ষ পদ বাগিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত ওলামা লীগের ক্ষমতা ব্যবহার করে মাদ্রাসাকে বানিয়েছেন অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। কোনো প্রকার নিয়মনীতি ছাড়াই নিজের ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার দাপটে মাদ্রাসার অন্য শিক্ষকদের চাপে রাখেন তিনি। নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন মাদ্রাসার কর্মচারীদের। বিপুল অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ দেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী।

নিজাম উদ্দিনের অনিয়ম আর প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ পেলে তদন্ত শুরু করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। তদন্তে তার জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। এসব জালজালিয়াতির বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত নিজাম উদ্দিনকে চিঠি দেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাকির হোসাইন। সাত কর্মদিবসের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও অদৃশ্য কারণে এ প্রক্রিয়া থেমে যায়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্ধ কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। আর সুস্পষ্টভাবে জালিয়াতি প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে আছেন ভুয়া অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকির হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমরা জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছি। অভিযুক্তকে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তিনি ‍উপস্থিত হননি এবং যথাযথ কাগজপত্র দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরাও কাজগপত্র বিশদ যাচাই করতে পারিনি। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তে যা দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।’ সময়ক্ষেপণের বিষয়ে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না, আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব।’

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার পর মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে গত ২১ নভেম্বর অভিযুক্ত নিজাম উদ্দিনকে ফের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাকে উপযুক্ত কাজগপত্রসহ আগামী ১ ডিসেম্বর উপপরিচালক মো. জাকির হোসাইনের কাছে সশরীরে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


নিজাম উদ্দিনের জালিয়াতির ফিরিস্তি

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী কৃষি শিক্ষক হওয়ার জন্য ‘কৃষি ডিপ্লোমা’ আবশ্যক। অথচ ডিপ্লোমা না থাকা সত্ত্বেও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে লুৎফুন্নেসা মহিলা আলিম মাদ্রাসার কৃষি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেন নিজাম উদ্দিন। ভুয়া নিয়োগ কমিটি দেখিয়ে এই নিয়োগ বাস্তবায়ন করেন। ‘২০১৯২৪১’ নম্বর ইনডেস্ক ব্যবহার করে ২০০৪ সাল থেকে পূর্ব ওমরাবাজ লুৎফুন্নেসা মহিলা আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।

এরপর বাধ্যবাধকা থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধন ছাড়াই হয়ে যান প্রভাষক। এক্ষেত্রে কৃষি শিক্ষকের (২০১৯২৪১) একই ইনডেক্স ব্যবহার করেন তিনি। যা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছে। অর্থাৎ কৃষি শিক্ষকের ইনডেক্স ব্যবহার করে প্রভাষক পদে চাকরি করছেন। নিজাম উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা, জীবনবৃত্তান্ত ও অন্যান্য নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। ২০০৪ সালে পূর্ব ওমরাবাজ লুৎফুন্নেসা মহিলা আলিম মাদ্রাসার কৃষি শিক্ষক হওয়ার পর ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট চরমাদ্রাজ ফাজিল মাদ্রাসায় কৃষি শিক্ষক পদে যোগদান করেন। একই বিষয়ের ওপর তিনি ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। অর্থাৎ এমপিওভুক্তির নথি অনুযায়ী তিনি ২০১৫ সাল পর্যন্ত কৃষি শিক্ষক ছিলেন।

এরপর ২০০৫ সালের শিক্ষক নিবন্ধন বিধি অমান্য করে প্রভাষক পদে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে অবৈধভাবে নিয়োগ নেন। অর্থাৎ ২০০৫ সালের পরে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে তাকে অবশ্যই নিবন্ধনধারী হতে হবে। অথচ প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ নেওয়ার জন্য তিনি ভুয়া কাগজপত্রের আশ্রয় নেন।

এর পর অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য ভয়ংকর প্রতারণার আশ্রয় নেন নিজাম উদ্দিন। চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য যে শর্ত কিংবা একজন শিক্ষকের যে যোগ্যতা থাকা আবশ্যক এর কোনোটিই ছিল না তার। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের নীতিমালা অনুযায়ী অধ্যক্ষ হতে ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে প্রভাষক পদে ১২ বছর এবং সহকারী অধ্যাপক পদে তিন বছর চাকরির অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকায় নতুন ফন্দি আঁটেন তিনি। আগের অধ্যক্ষ বহাল থাকা অবস্থায় তাকে মৃত দেখিয়ে ২০১৬ সাল থেকে অধ্যক্ষ পদে যোগদান দেখান তিনি। অথচ তখন প্রভাষক হিসেবে তার চাকরির অভিজ্ঞতা মাত্র এক বছর। সে হিসেবে তিন বছর সহকারী অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা থাকার কোনো সুযোগই ছিল না। অর্থাৎ ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা ঘাটতি রেখে অধ্যক্ষ হয়েছেন। একই সময়ে মাদ্রাসাটিতে আগের অধ্যক্ষ বহাল ছিলেন। আগের অধ্যক্ষ অবসরে গেছেন এক বছর পর ২০১৭ সালে। 

অপরদিকে নিজাম উদ্দিন ২০১৬ সাল থেকে অধ্যক্ষ পদে থাকলেও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির নথিপত্র অনুযায়ী ২০২১ সালে তিনি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। আবার তার অধ্যক্ষ থাকাকালীন অবস্থায় মাদ্রাসাটিতে আরেকজন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। অর্থাৎ নিজের জালে নিজেই আটকে গেছেন ভুয়া অধ্যক্ষ নিজাম উদ্দিন। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গোপনে অধ্যক্ষ পদে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন তিনি। এরপর মাদ্রাসার গভর্নিংবডি, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির স্বাক্ষর জাল করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নেন। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ এটিএম আবদুর রউফ চাকরি থেকে অবসর নেন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর পর ২০১৯ সালে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিজাম উদ্দিন। তার আগে অনেক সিনিয়র শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও দলীয় ক্ষমতা এবং পেশিশক্তির বলে এই পদে দায়িত্ব নেন তিনি। সমালোচনার প্রেক্ষিতে মাদ্রাসার সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মো. ইদ্রিসকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেয় ম্যানেজিং কমিটি। অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসাটিতে কাগজে-কলমে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন নিজাম উদ্দিন। অথচ ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে অধ্যক্ষ হিসেবে এটিএম আবদুর রউফ এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মো. ইদ্রিস এবং নিজাম উদ্দিন নিজে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে হিসেবে আলোচ্য সময়ে (২০১৬ থেকে ২০২৪) মাদ্রাসটিতে চারজন অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন মেয়াদে তারা দায়িত্ব পালন করলেও সবসময়ই ছিল দুজন অধ্যক্ষ। নজিরবিহীন এ ঘটনা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি কেউ পরীক্ষা করে দেখেনি। এক্ষেত্রে নিজাম উদ্দিন কোথাও টাকা এবং কোথাও পেশিশক্তি ব্যবহার করেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত নিজাম উদ্দিন (হুমায়ুন সরমান) বলেন, ‘আমি কাগজপত্র জমা দিয়েছি, আমার পক্ষে রিপোর্ট এসেছে।’

তবে শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, তিনি কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিয়ষটি প্রক্রিয়াধীন। কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে সূত্রটি জানায়, প্রথমত নিয়োগ বাতিল করে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া সরকারি অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা