কুমিল্লা ও বুড়িচং প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:২৭ পিএম
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ২১:৩৮ পিএম
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কালিকাপুর রেলক্রসিং এলাকায় দুর্ঘটনাকবলিত অটোরিকশার যন্ত্রাংশ পড়ে আছে রেললাইনের মাঝখানে। ছবি : সংগৃহীত
কুমিল্লার বুড়িচংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সাত যাত্রী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন একজন। নিহতদের মধ্যে চারজন নারী ও তিনজন পুরুষ। তাদের মধ্যে একজন নারী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় জেলার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর রেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজনই উপজেলার বাকশিমূল গ্রামের বাসিন্দা। তারা হলেনÑ তৈয়ব আলীর ছেলে অটোচালক সাজু মিয়া (৩৮), মৃত মুনসুর আলীর ছেলে আলী আহমেদ (৮০), মৃত আবদুল খালেকের স্ত্রী লুৎফা বেগম (৫৫), মনির হোসেনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শাহিনুর আক্তার ওরফে শানু (৩৫) ও আলী আশ্রাফের স্ত্রী সফরজান বেগম (৬৫)। অপর দুজন খোদাইধুলি গ্রামের মৃত আছমত আলীর ছেলে রফিস মিয়া (৬০) ও মৃত ফজলু মিয়ার স্ত্রী হোসনেয়ারা বেগম (৬৫)।
স্থানীয়রা জানায়, মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ‘চট্টলা এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর রেলক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশায় থাকা চার যাত্রী ঘটনাস্থলে মারা যান। এ ছাড়া হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত তিনজনকে হাসপাতালে নিলে তাদের মধ্যে দুজন মারা যান। আরও একজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রেলওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, অটোচালকের অসাবধানতার কারণেই প্রাণ গেছে চালকসহ সাতজনের। বাকশিমূল গ্রাম থেকে সাজু মিয়ার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে সবাই পাশের গাজীপুর বাজারে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কালিকাপুর এলাকায় রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী অটোরিকশাটি হঠাৎ রেলপথে উঠে যায়। এতে ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলের আশেপাশে নিহত ব্যক্তিদের লাশ রেলপথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
স্থানীয়রা জানায়, নিহত সফরজান বেগমের শরীরের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশ খুঁজে বের করেন তার মেয়ে। এ ছাড়া ট্রেনের নিচে পড়ে অন্তঃসত্ত্বা শাহিনুর আক্তারের লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে তার গর্ভের সন্তানও বের হয়ে আসে।
শাহিনুরের স্বামী মনির হোসেন বলেন, ১০ বছর আগে বিয়ে হয় আমাদের। মঙ্গলবার সকালে সে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে অটোরিকশায় চড়ে উপজেলার গাজীপুর এলাকায় যাচ্ছিল। এমন সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে জানলাম, শাহিনুরের লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে তার গর্ভে থাকা আমাদের অনাগত সন্তানও বের হয়ে আসে। আমার স্ত্রীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হবে ভাবতেও পারিনি। কতই না কষ্ট পেয়েছে সে। তার কত স্বপ্ন ছিল সন্তানদের নিয়ে। এখন সবই কল্পনার মতো মনে হয়।
লাকসাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমরান হোসেন বলেন, ওই এলাকায় রেলওয়ের কোনো বৈধ লেভেল ক্রসিং নেই। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই লেভেল ক্রসিং অবৈধ। অটোরিকশা চালকের অসাবধানতার কারণে এতগুলো প্রাণ গেছে। আমরা ঘটনাস্থলে একজনের মরদেহ পেয়েছি। বাকিদের মরদেহ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়রা জানায়, অটোরিকশা চালক সাজু মিয়া ছিলেন একজন কাঠের মিস্ত্রি। কয়েক বছর আগে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিনে সেটি চালাতেন। মূলত তার অদক্ষতাতেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তারা আরও জানান, রেলক্রসিংটি দিয়ে প্রতিদিন হাজারখানেক মানুষ চলাচল করে। এ জায়গায় রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এর আগেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এখানে রেলগেট নির্মাণ করা হলে এই দুর্ঘটনা দেখতে হতো না।
এ ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সে সময় তিনি ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলেন। ট্রেনটি হুইসেল দিয়ে আসছিল। এরপরও চালক সাজু মিয়া তার অটোরিকশা নিয়ে রেললাইনে উঠে পড়েন। দুর্ঘটনার পর আশপাশের মানুষ চিৎকার দিয়ে ছুটে আসেন। আধা ঘণ্টার মধ্যেই নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে চলে আসেন। এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরের অংশগুলো সবাই তুলে বাড়িতে নিয়ে যান। ঘটনাস্থলের আশে পাশে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বলেও জানান তিনি।
এদিকে দুর্ঘটনার পরে একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা কালিকাপুর রেলক্রসিংটিকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে একটি ব্যানার লাগাতে এলে স্থানীয়রা তাকে আটকে রাখে। এ সময় রেলক্রসিংয়ের সিগন্যালসহ নিরাপদে যাত্রী ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থার দাবি তোলে তারা। পরবর্তী সময়ে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার ও সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় ইউএনর জানান, দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
এদিকে ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মো. কামরুজ্জামান। তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেলওয়ে কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী প্রকৌশলীকে। অন্যরা হলেন পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা, সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এবং সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী।