আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০১ পিএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০১ পিএম
ফাইল ফটো
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ‘ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা’ হেলমেট পরে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদল। শুক্রবার মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাব্বির আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এমন দাবি করে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় ছাত্রদল। এর প্রতিবাদে দুপুরে ‘ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে চট্টগ্রাম ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা চট্টগ্রামের একমাত্র সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি ছিল না।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নেতৃত্বাধীন একটা পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে। শুরু থেকেই ছাত্রদলের দাবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিবির চট্টগ্রামের ক্যাম্পাসগুলো দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও শিবিরের পক্ষ থেকে বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তবে সমন্বয়ক রাসেল আহমেদের বক্তব্য ছাত্রদলের দাবির পক্ষে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের হোস্টেল এলাকায় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থী, পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে হোস্টেল দুটি বন্ধ ছিল। সম্প্রতি নিয়মের তোয়াক্কা না করে শিবিরের নেতাকর্মীরা তাদের মতো হলের আসন বরাদ্দ করায়। এটি জানাজানি হলে আসন বরাদ্দের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদল সেই আন্দোলনে সমর্থন দিলে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার আসন বরাদ্দ পাওয়া ছাত্ররা হলে উঠতে গেলে বিরোধী পক্ষ বাধা দেয়। যার ফলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনাকে চট্টগ্রাম কলেজের স্টাইলে ক্যাম্পাস দখলের চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরীফুল ইসলাম তুহিন। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে শিবির কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গোপনে তাদের ছেলেদের হলে তুলে দিচ্ছে। এমনকি সূর্যসেন নামে একটা হোস্টেল আছে যেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য, সেখানেও তারা তাদের কর্মীদের তুলছে। এসবে বাধা দিলে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ থেকে বহিরাগতদের নিয়ে এসে হেলমেট পরে শিবির ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। খবর পেয়ে আমরাও সেখানে যাই।’
গত বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষ ও শুক্রবারের সমাবেশ দুই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চট্টগ্রাম কলেজের সমন্বয়ক ইবনে হোসেন জিয়াদ ও মহসিন কলেজের সমন্বয়ক এজিএম বাপ্পী। তারা দুজন দুই কলেজে শিবিরের সাধারণ সম্পাদক এমনটাই দাবি ছাত্রদল, কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের। যদিও জিয়াদ কিংবা বাপ্পী এই অভিযোগ স্বীকার করেন না। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি ছিল না রাসেলের এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে হোসেন জিয়াদ বলেন, ‘রাসেল এখন দলীয় দালালি করছে। তার সঙ্গে কথা বলেই আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সে আসবেও বলেছে। এখন কেন এমন কথা বলছে, তা বলতে পারব না।’ তাদের বিরুদ্ধে শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জিয়াদ বলেন, ‘এটি ট্যাগিং রাজনীতি। আগে ছাত্রলীগ করত এখন ছাত্রদল একই রাজনীতি করছে।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজেও দীর্ঘদিন ধরে এমন দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পাস দখলকে কেন্দ্র করে এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুখোমুখি অবস্থায় শিবির ও ছাত্রদল। এর আগে চট্টগ্রাম কলেজে দুই দফা হামলার শিকার হয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। হামলার পর হামলাকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল ছাত্রদল কলেজে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিহত করে।
শিক্ষার্থীদের মোবাইল চেক, মারধর ও নিপীড়নের অভিযোগ
শুধু ছাত্রদল নয়, শিবিরের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ থাকা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের এসব ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হতে হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থী কিংবা বৈষম্যবিরোধী ব্যানার ব্যবহার করে যারা এসব হামলা করছে তারা সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতÑ এটি এখন ওপেন সিক্রেট, এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষার্থীরাও এসব হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। হামলার শিকার তেমনি একজন মহসিন কলেজের বিএসসি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সবুজ। আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। সে সময় তিনি বহদ্দারহাটে শিক্ষার্থীদের মিছিল থেকে একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেন, এমন একটি ফুটেজও প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে আছে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সবুজ বলেন, ‘হঠাৎ বহিরাগত ১০-১২ জন ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে। আমার তিনজন বান্ধবীসহ কয়েকজন বন্ধুও ছিল সঙ্গে। রক্ষা করতে এলে মেয়েদের দিকেও তারা তেড়ে যায়। এর মধ্যে হান্নান নামের বাকলিয়া কলেজের একজনকে আমি চিনি। সে আগে থেকে শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। মনিরুল নামে একজন মারধরের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, তিনিও শিবিরের রাজনীতি করেন। সম্ভবত কলেজের শিবিরের ছেলেরা তাদের দিয়ে এই হামলা করিয়েছে। কারণ আন্দোলনের পর আমরা ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত রাখার বিষয়ে কথা বলছিলাম।’
গত তিন মাসে চট্টগ্রাম মহসিন কলেজে শতাধিক শিক্ষার্থীকে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। তিন দিন আগে শাহরিয়ার নামে ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরানো হয়। পরে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। ২৫ নভেম্বর থেকে ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে কলেজে গেলে সদ্যনিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে তাকে পেটানো হয়। তার মোবাইল চেক করে এমন প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় হামলাকারীরা। গত বৃহস্পতিবার একই কায়দায় ইসরাত জাহান তন্নি ও তালজিল হাসান নামে দুই শিক্ষার্থীকে পুলিশে দেওয়া হয়। তাদেরও মোবাইল চেক করা হয়। তানজিলকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। ইসরাতকে চড়-থাপ্পড় দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র। পরে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
মহসিন কলেজে এটি এখন নিয়মিত ঘটনা উল্লেখ করে কলেজের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারের ২০-২৫ জনের প্রবেশপত্র ছাত্রনেতারা নিয়ে গেছে। এগুলো তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে।’ কোন ছাত্রনেতারা নিয়েছেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শিবিরের সভাপতি আনোয়ার ভাই ও সেক্রেটারি এজিএম বাপ্পী ভাই নিয়ে গেছেন। ক্যাম্পাসে কাউকে সন্দেহ হলে তারা মোবাইল চেক করেন। মারধর করেন। সেদিকে তাকাইও না। তাকাতে গেলে বলে দালালি করছি।’
তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এজিএম বাপ্পী। তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরাই তাদের আটক করে। পরে আমি গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিই । কোনো মারধর করতে দিইনি।’ যদিও থানায় নেওয়ার পর তানজিল হাসানের কান থেকে রক্ত ঝরছিল বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। বিকালে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসা করায় পুলিশ। এসব নথিও সংরক্ষিত আছে প্রতিবেদকের কাছে।
শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, পুলিশও তাদের গ্রেপ্তার করে হামলার বিষয়ে নীরব থাকছেÑ এমনই অভিযোগ নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থী ও স্বজনদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ক্রাইম) বলেন, ‘কেউ আসামি ধরে দিলে তো পুলিশ নেবে। যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’ এসব বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে আগ্রহ দেখাননি এই কর্মকর্তা। তবে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারাও বিরক্ত। কিন্তু ঊর্ধ্বতন মহল ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ভিন্ন কোনো উপায়ও নেই তাদের।
কী বলছে শিবির
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি ফখরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘তিন ক্যাম্পাসের কোথাও আমাদের কমিটি নেই। এসব ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় আমরা কমিটি দিইনি। তবু ছাত্রদল বারবার এই একই অভিযোগ করছে। এটা ট্যাগিংয়ের রাজনীতি। এসব ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের বিরোধ।’
ক্যাম্পাসে নিপীড়নের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রবেশপত্র নিয়ে নেওয়া বা মোবাইল চেক, মারধর করা এসব সমর্থন করি না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকে পুলিশে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু নিপীড়নের সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন আমরা এসবের শিকার হয়েছি। অন্য কেউ হোক তা চাইব না। এখন যাদের পুলিশে দেওয়া হচ্ছে তাদের এজিএম বাপ্পীরা দিচ্ছে। তারা কী পরিস্থিতিতে কী করছে তা জানি না। তবে তারা শিবিরের কেউ না।’
তবে গতকাল ষোলশহরে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত শিবিরের পদধারী এক নেতা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা সম্মিলিত শিবিরের কর্মসূচি ছিল না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমাদের (শিবিরের) সমর্থন যে অংশের প্রতি আছে তারাসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে এটি হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এটি বলতে পারেন।’