তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৫৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
যশোরের বাহাদুরপুরে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন সারের গোডাউনের ঠিকাদার সালাউজ্জামান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সার ওঠা-নামার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ঠকিয়ে গত কয়েক বছরে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ বাগিয়ে নিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক না দিয়ে এক অর্থবছরে ভোগ করেন সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে যশোর-বাহাদুরপুর মহাসড়কের পাশে ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার গোডাউন নির্মিত হয়। যদিও বেশিরভাগ সময়ে সারের মজুদ থাকে ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। চট্টগ্রামের ইউরিয়া ফার্টিলাইজার থেকে সার এনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এখানে সংরক্ষণ করা হয়। এসব সার ট্রাকে ওঠানো-নামানোর জন্য ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয় শ্রমিক। রাজনৈতিক বিবেচনায় গত ১০ অর্থবছরের অর্ধেক সময়ই নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সালাউজ্জামানের অধীন ছিল শ্রমিক নিয়োগের কাজ। সূত্র জানায়, তিনি ভারতে নিহত হওয়া ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল ইসলাম আনারের ব্যবসায়িক সহযোগীও ছিলেন।
বিসিআইসির কাছ থেকে ট্রাকে সার ওঠা-নামানোর জন্য টনপ্রতি ৫৫ টাকা ৫৫ পয়সা ধার্য করা হয়। কিন্তু সালাউজ্জামান সাধারণ শ্রমিকদের প্রতি টনে মাত্র ১৫ টাকা হারে পরিশোধ করেন; যা সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের চার ভাগের এক ভাগ। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের মাঝেও চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তবে কাজ হারানোর ভয়ে কোনো শ্রমিক এ বিষয়ে মুখ খোলেন না। কেউ কখনও প্রতিবাদ করলে পরের দিনই তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডার দিয়ে তাদের লাঞ্ছিত করা হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট সার সংরক্ষণ করা হয় ৫৩ হাজার ৪১৯ টন। গোডাউন থেকে সরবরাহ করা হয় ৫২ হাজার ৫৫৪ দশমিক ২৫ টন। গোডাউন ৩৫ থেকে ৪০ জন শ্রমিক প্রতিদিন এসব মাল ওঠানো-নামানো করে থাকেন। চলতি অর্থবছরে মোট ৯৭ হাজার ৫৩৫ দশমিক ৯৫ টন সার ওঠানো-নামানোর কাজ করেন এসব শ্রমিক। এ কাজে ঠিকাদার সালাউজ্জামান টনপ্রতি ৪০ টাকা ৫৫ পয়সা হারে শ্রমিকদের প্রাপ্য লুট করেন ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী চক্রটি গত ১৫ বছরে শ্রমিকদের প্রায় ৬ কোটি টাকা লুট করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শ্রমিক জানান, এখানে যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক কাজ করেন। ঠিকাদার টনপ্রতি ৫৬ টাকা পেলেও যারা দিন-রাত সারের বস্তা বয়ে ট্রাকে ওঠানো-নামানোর কাজ করেন, তাদের দেওয়া হয় মাত্র ১৫ টাকা। কেউ প্রতিবাদ বা মুখ খুললে পরের দিন তাকে বাদ দেওয়া হয়। তা ছাড়া এক ট্রাক মাল আনলোড করলে ড্রাইভার শ্রমিকদের ৫৫০ টাকা দেন। শ্রমিকরা তা থেকে ৫০ টাকা দেন গোডাউন ইনচার্জকে।
বিষয়টি নিয়ে গোডাউন ইনচার্জ আক্তারুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিকাদার কাজ ধরে শ্রমিক নিয়ে করেন। তারা কীভাবে শ্রমিকদের ম্যানেজ করেন তা আমাদের জানার বিষয় না। শ্রমিকদের বকশিশের টাকায় ভাগ বসানোর বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে ঠিকাদার সালাউজ্জামান বলেন, আমি কাজ পেয়েছি ঠিক কিন্তু করি না। যশোরে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, তারা কীভাবে কাজ চালানÑ সেটি আমার জানা নেই।
চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানার ম্যানেজার কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করি। প্রতি টন মালামাল লোডের জন্য শ্রমিকদের ৫৫ টাকা ৫৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের কী পরিমাণে দেওয়া হয় তা আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় ঠিকাদাররা খেয়ালখুশি মতো কাজ করান। তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা এলে এসব ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।