সুনীল দাস চৌধুরী, খুলনা
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:৩৪ পিএম
খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার অধিবাসী গৃহবধু রনজিলা বাসির। গত জুন মাসে সদর থানার আওতাধীন বানিয়াখামার মৌজায় তার পৈতৃক জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুম শাখায় অনলাইনে আবেদন করেন। প্রতিটি খতিয়ানের জন্য ১৪০ টাকা হারে ১০টি খতিয়ানে তিনি ১৪০০ টাকা সরকারি ফিস দেন। প্রায় ১০ দিন পরে ডাকপিয়ন তাকে খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ১০টি চিঠি দিয়ে যান। চিঠিগুলো খুলে তিনি দেখতে পান প্রতিটি চিঠিতে লেখা রয়েছে খতিয়ানের ভলিয়ম (আরওআর) বইয়ের পাতা বিনষ্ট থাকায় উক্ত মৌজায় আপনার আবেদনকৃত খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তিনি জমির নামজারি ও জমি বিক্রি নিয়ে চরম জটিলতায় পড়েছেন। ইতিমধ্যেই জমি নিয়ে জালিয়াত চক্রের রোষানলেও পড়েছেন। এ সমস্যা থেকে উদ্ধারের পথও তিনি কিভাবে পাবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না।
নগরীর মৌলভীপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী বিধান বিশ্বাস তার পৈত্রিক সম্পত্তি দাকোপ উপজেলার চুনকুঁড়ি মৌজায় জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির জন্য চলতি বছরের মে মাসে অনলাইনে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে তাকেও লিখিতভাবে জানানো হয়, এসএ খতিয়ানের আরওআর বই বিনষ্ট বিধায় আবেদনকৃত খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব নয়। বিধান বিশ্বাসের আদালতের একটি মামলায় বিচারক তর্কিত ভূমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি চেয়েছেন। এখন তিনি আদালতকে সার্টিফাইড কপি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে বিবাদী পক্ষের জাল দলিল ও রের্কডের কাগজপত্র আদালতে দিয়ে মামলায় সুবিধা নিয়ে নেবেন বলে আতংকে রয়েছেন। তিনি সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়ন তহশীল অফিসে যোগাযোগ করেও তার পৈত্রিক জমির খতিয়ানের কপি না পেয়ে চরম জটিলতায় পড়েছেন।
শুধুই রনজিলা বাসির বা বিধান বিশ্বাসই নয় খুলনা জেলার প্রায় ১০ লাখ লক্ষ মানুষ জেলা রেকর্ডরুমে এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির আবেদন করেও কাঙ্খিত জমির খতিয়ানের কপি না পেয়ে চরম র্দূভোগে পড়ছেন প্রতিনিয়ত। অনলাইনে নির্ধারিত সরকারি ফিস দিয়েও কাঙ্খিত ভূমি সেবা না পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন গ্রামের অসংখ্য মানুষ। জেলা রেকর্ড রুমে রাখা এসএ খতিয়ানের মূল আরওআর বইয়ের পাতা বিনষ্ট হয়ে যাওয়াই সাধারণ মানুষের ভোগান্তির মূল কারণ। এতে একদিকে যেমন ভূমির মালিকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি পড়ছেন দালাল, ভূমিদস্যু ও দলিল জাল-জালিয়াত চক্রের খপ্পরে। আদালতেও ভূমি মালিকেরা বিভিন্ন মামলায় তাদের জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি প্রদর্শণ করতে পারছেন না। ফলে সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঘুরতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে। কখনও কখনও জালিয়াত চক্র, দালাল ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের অসাধু কর্মচারীদের বেশি টাকা দিয়ে নকল সার্টিফাইড কপি নিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে, এসএ খতিয়ানের কপি না পাওয়ায় অনেকেই একশ্রেণির ভূমিদস্যু ও জাল-জালিয়াত চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
ভুক্তভোগী নগরীর বানিয়াখামার এলাকার মাহমুদুল হক জানান, গত মার্চ মাসে বানিয়াখামার মৌজায় আমাদের জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনলাইনে ৫টি আবেদন করি। প্রতিটি আবেদনের জন্য ১৪০ টাকা খরচ করা হলেও আমরা কোনো খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি পাইনি। আমাদের লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- ‘খতিয়ানের ভলিউম বইয়ের পাতা বিনষ্ট’। এখন আমরা রেকর্ড সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা করতে পারছি না। এজন্য আমার পৈত্রিক জমি ভূমিদস্যুরা দখল করে নিচ্ছে। জেলা রেকর্ড রুমে খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট হয়ে গেছে এ দায়ভার তো আমাদের নয়। কেন এসব ভলিউম বই সরকারের সংশ্লিষ্ঠ দপ্তর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছে না। যার জন্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
নগরীর দেবেন বাবু রোডের নার্গিস বেগম জানান, তাদের জমিজমা নিয়ে হাইর্কোটে একটি মামলা রয়েছে। সেই মামলায় আদালত জমির খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি জমা দেওয়ার জন্য বলেছেন। তিনি জমির খতিয়ানের কপি পেতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সংশ্লিষ্ট রের্কড রুমে অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু রের্কড রুমের অফিসাররা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন খতিয়ানের ভলিউমের পাতা বিনষ্ট থাকায় কপি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। খতিয়ানের কপি না পাওয়ায় আদালতের মামলা নিয়েও চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রের্কড রুমের সংরক্ষিত যে সব খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট সেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করার জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান।
খুলনা মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেয়ে গত আগষ্ট মাস থেকে অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আশে পাশের কম্পিউটারের দোকানগুলোতে অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেকেই এভাবে এসএ খতিয়ান না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট থাকায় জেলা প্রশাসকের কিছু অসাধু র্কমচারীর যোগসাজসে ভূমিদস্যু ও জালিয়াত চক্রের সদস্যরা খোঁজ খবর নিয়ে ওইসব জমির জাল খতিয়ান তৈরি করে দখলের পায়তারা করছে। এরই মধ্যে খুলনা মহানগরী, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, রূপসা, তেরখাদা ও ফুলতলা এলাকার অনেকের জমি খতিয়ান জালিয়াতির মাধ্যমে বেদখল হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
খুলনা মহানগর ও জেলার ৯টি উপজেলার কতগুলো খতিয়ানের ভলিউম বই বা আরওআর বই বিনষ্ট হয়েছে তা জানতে গত ২১ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের দেওয়া লিখিত তথ্য মতে, খুলনা মহানগর ও ৯টি উপজেলায় ৭৬৮টি মৌজা রয়েছে। এ সকল মৌজায় ৩ লক্ষ ৪ হাজার ৪২৯টি এসএ খতিয়ান ভলিউম বই আকারে সংরক্ষণ করা রয়েছে। এর মধ্যে বিগত সরকারের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৮৯টি খতিয়ান ডিজিটাল সিস্টেমে এন্ট্রি করা হয়েছে। বাকি ৬৯ হাজার ১৪০টি খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট হওয়ায় সেগুলো ডিজিটাল সিস্টেমে অনলাইন এন্ট্রি ও আপলোড দেওয়া সম্ভব হয়নি।
লিখিত তথ্যে আরও জানা যায়, জনভোগান্তি লাঘবে রের্কডরুমে রক্ষিত ভলিউমের বিনষ্ট খতিয়ানের কপিসমূহ উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট সেবা প্রত্যাশীদের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
তবে বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে গিয়ে সেবা গ্রহীতারা বিনষ্ট খতিয়ানের কোনো কপি সংগ্রহ করতে পারছেন না।
জেলা প্রশাসকের রের্কড রুমের তত্বাবধায়ক মো. আব্দুল বারী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তিনি রের্কডরুমে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশকিছু সেবা প্রত্যাশীরা আবেদন করলেও খতিয়ানের ভলিউম বইয়ের পাতা নষ্ট থাকায় সেগুলোর সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। খতিয়ানের কপি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের শেষ অবধি অনলাইনে ডাটা এন্ট্রি করা হয়েছে। তারপরে প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট র্কমর্কতা ও জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জনগণের সেবা প্রদানে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর জেলা রেকর্ড রুম। সেখানে রক্ষিত জমির জনগুরুত্বপূর্ণ এসএ খতিয়ানের এতগুলো পাতা বিনষ্ট থাকবে এবং জনগণকে তাদের চাহিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে না। এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এখানে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতি রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ এখনও নেওয়া হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। সংরক্ষিত খতিয়ান ভলিউমের নষ্ট পাতা দ্রুত সংগ্রহের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবের দাবিও জানান এই নাগরিক নেতা।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মীর আলিফ রেজা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, খুলনা জেলা রেকর্ডরুমে ব্রিটিশ আমল থেকে যে সকল রেকর্ড বই সংরক্ষিত রয়েছে। সেগুলো ডিজিটাল রেকর্ডরুম সিস্টেমের মাধ্যমে রেকর্ডগুলো এন্ট্রি করা হয়। কিন্তু এখনও সর্ম্পূণ ডাটা এন্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। আমরা জেলার ভূমি অফিস ও সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসগুলোতে সংরক্ষিত না থাকায় ঢাকায় জরিপ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছি। এছাড়া জেলা জজ আদালতের রেকর্ড রুমেও আমরা যোগাযোগ করছি। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে বিনষ্ট হওয়া রেকর্ড সংগ্রহ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিজিটাল সিস্টেমে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।