হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:২০ এএম
চট্টগ্রাম বে টার্মিনাল প্রকল্প। ছবি : সংগৃহীত
দুই দফায় মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের পরও বহুল আলোচিত চট্টগ্রাম বে টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তাই প্রকল্পটি আবারও মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আজ রবিবার ৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগের এ প্রকল্প নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়ে। বৈঠকে অংশ নেবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন। পাশাপাশি উপস্থিত থাকবেন বিনিয়োগকারী সংস্থা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কর্তৃপক্ষসহ অন্য অংশীদাররা।
এ প্রসঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বে টার্মিনাল নিয়ে কাল (রবিবার) মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে উপদেষ্টা মহোদয় স্টেক হোল্ডারদের কাছ থেকে প্রকল্পটির বিষয়ে জানবেন। সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিশ্বব্যাংক, টার্মিনাল তৈরিতে বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরবেন।’
বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা এবং আগামীতে সক্ষমতা কতটুকু বাড়ানো উচিতÑ এসব বিষয় পর্যালোচনা করতেই এ সভা হচ্ছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তনও আসতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দর কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈঠকে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং বন্দরের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুনরায় পর্যালোচনা করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পটির অধীনে সেখানে একটি লিকুইড টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। ওই লিকুইড টার্মিনালটিতে জ্বালানি তেল খালাস করা হবে। তাই প্রকল্পটির পরিবেশগত সুরক্ষার বিষয়গুলোও বৈঠকে আলোচনা করা হতে পারে। আলোচনার পর কিছু পরিবর্তন অবশ্যই আসবে।’
এ সম্পর্কে জানতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দেলোয়ারা বেগমকে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মুহিদুল ইসলামকে কল করা হলে তিনি জানান, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিতে রয়েছেন।
এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুকের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানে আবার কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, সেটি আমরা এখনও নিশ্চিত নই। প্রকল্পে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়টি কাল বৈঠকের পর জানা যাবে। বৈঠকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির কথা রয়েছে।’
বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার ২০১৫ সালে বে টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১৭ সালে নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর তীরের ৮৭০ একর জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে প্রকল্পাধীন পুরো জায়গা অধিগ্রহণের কাজ শেষ করেছে। কিন্তু গত আট বছরেও টার্মিনাল তৈরির কাজ শুরু করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। বারবার মাস্টারপ্ল্যান পরিবর্তন, বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তিস্বাক্ষর না হওয়ায় এখনও অনিশ্চয়তায় বে টার্মিনাল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। প্রথমে প্রকল্পের অধীনে বে টার্মিনাল প্রকল্পের আওতায় তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হলেও এখন ওই প্রকল্পের অধীনে এই তিনটি টার্মিনালের পাশাপাশি জ্বালানি তেল খালাসের জন্য একটি লিকুইড টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুরুতে তিনটি টার্মিনালের মধ্যে মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন সেটি নির্মাণে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে আবুধাবি পোর্ট। এ ছাড়া প্রাইভেট, পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) অধীনে বাকি দুটি টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টান্যাশনাল পোর্ট, অন্যটি নির্মাণে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুবাই পোর্ট। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে সব ধরনের আলাপ-আলোচনা শেষ হলেও চূড়ান্ত চুক্তিস্বাক্ষর হয়নি।
এই অবস্থায় আবারও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করতে আজ বৈঠক করতে চলেছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। বৈঠকে মাস্টারপ্ল্যান পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরিরও কথা রয়েছে। এতে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো আপত্তি এলে টার্মিনাল নির্মাণ কাজ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির জন্য ২০১৭ সালে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। ওই সময় মাস্টারপ্ল্যানের লে-আউটে তিনটি শেডের মধ্যে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল শেড মাস্টারপ্ল্যানে উত্তরপ্রান্তে রাখা হয়। ওই মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন হওয়ার আগে সেটিতে আবার পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৭ সালের মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করে ২০২২ সালে আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডাইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়। এই মাস্টারপ্ল্যানে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হতে যাওয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল শেড মাঝখানে রাখা হয়। একই মাসে মাস্টারপ্ল্যানটি বন্দরের বোর্ড মিটিংয়ে পাস হওয়ার পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সেটি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী একই বছরের জুন মাসে ডিটেল ড্রয়িং ডিজাইনিংয়ের কাজ শেষ করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
এদিকে মাস্টারপ্ল্যানে পরিবর্তন হওয়ায় বে টার্মিনাল নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ও এক্সেস চ্যানেল ড্রেজিংয়ের সম্ভাব্যতা যাচাইয়েও পরিবর্তন আনতে হয়। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেলহর্ন-ডব্লিউএসপি-কেএস-একুয়ার (জেভি) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের জুনে প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। তবে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগ মুহূর্তে পুনরায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে বে টার্মিনাল কোন জায়গা থেকে শুরু হলে বন্দরের জন্য ভালো হবে, সে বিষয়ে মতামত চেয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যালোচনা বৈঠকে মাস্টারপ্ল্যানে কোনো পরিবর্তন এলে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।