শাহিনুর সুজন, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৮ পিএম
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪ পিএম
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার টাঙ্গন এলাকায় পদ্মা নদীর মাঝে থেকে বালু উত্তোলন।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার টাঙ্গন এলাকায় নদীভাঙন থেকে রক্ষা প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে বাঁধের পাশের পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। এতে হুমকিতে পড়েছে ওই এলাকার তিনটি বিদ্যালয়, কলেজ ও বিজিবি ক্যাম্পসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ২০২৩ সালে জুন মাসের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ‘রাজশাহী জেলার চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় পদ্মা নদীর বাম তীরের স্থাপনাগুলো নদীভাঙন থেকে রক্ষা প্রকল্প’-এর আওতায় ৭২২ কোটি টাকার কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ৩০ জুন। এর মধ্যে রয়েছে চারঘাটের ইউসুফপুর ইউনিয়নের টাঙ্গন এলাকায় ২৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দে ৪০০ মিটার বাঁধ নির্মাণ, ভাঙন রোধে ৯১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা ও নদীপারের তিনটি পুকুর ভরাটের কাজ। এ কাজের দায়িত্ব পায় উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল নামে কক্সবাজারের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন খাজা তারেক সিজার নামের স্থানীয় এক ঠিকাদার।
সম্প্রতি সরেজমিনে চারঘাটের টাঙ্গন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ এলাকার কাজ শেষ হলেও সেখানে ৪০০ মিটার বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। নদীর বাঁধ টেকসই করার কথা বলে বাঁধ নির্মাণের জায়গা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তিনটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। নদীর মাঝখানে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে ট্রলারে করে সেই বালু এনে ড্রেজারের মাধ্যমে পাইপলাইন দিয়ে সেই পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। এভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে আরও বেশি নদীভাঙনের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন ২০২৩ অনুযায়ী, সরকারি কার্যক্রম বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে বালু বা মাটি উত্তোলন, পরিবহন ও সরবরাহের অনুমোদনের ক্ষেত্রে বালু ভরাট বাবদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বা প্রকল্পের নির্ধারিত অর্থ সরকারের অনুকূলে জমা প্রদান করার পর বালু নেওয়া যাবে। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে বালু ভরাট বাবদ প্রায় ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সরকারের অনুকূলে জমা কিংবা কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার বালু উত্তোলন করে পুকুর ভরাট করছেন।
টাঙ্গন এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কাজ চলছে এক জায়গায় আর পুকুর ভরাট হচ্ছে অন্য জায়গায়। পদ্মা নদীর চারঘাটের কোনো অংশে বালু উত্তোলনের অনুমোদন নেই। কিন্তু পুকুর ভরাটের জন্য দরপত্রে আলাদা বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও নদীর মাঝখান থেকে বালু তোলা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন এসে বারবার নিষেধ করলেও ঠিকাদার কর্ণপাত করছেন না। বেশি লাভের আশায় এভাবে বালু তোলা হলে বাঁধ আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্থানীয় ইউসুফপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমদাদুল ইসলাম বলেন, খেয়ালখুশি মতো জিও ব্যাগ ফেলার পর এবার ইচ্ছেমতো নদীর বালু তুলে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। অনুমোদন ছাড়া বালু তোলার সংস্কৃতি চালু করলে আরও অনেকে সেই কাজে উৎসাহী হবে। শতভাগ কাজ আদায় করে নেওয়াটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ তো হচ্ছেই না, উল্টো দায়সারাভাবে কাজ করছে ঠিকাদার।
ঠিকাদার খাজা তারেক সিজার বলেন, বাঁধের এক কিলোমিটার দূরের নদীর তলদেশ থেকে বালি উত্তোলন করে পুকুর ভরাট করছি। এটাই নিয়ম, কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমতি নিয়ে কাজ বাস্তবায়ন করছি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহী পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান অঙ্কুর বলেন, দরপত্রে পুকুর ভরাটের জন্য আলাদা বরাদ্দ রয়েছে। ঠিকাদার কোথা থেকে বালি এনে ভরাট করবেন সেটা তার ব্যাপার। এ বিষয়ে আমাদের অনুমতির কোনো বিষয় নেই। কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি, তবে আগামী বর্ষাকালের মধ্যে শতভাগ শেষ হবে।
নদী থেকে বালি উত্তোলনের বিষয়ে চারঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন বলেন, আমি জায়গাটি পরিদর্শন করেছি। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমাদের কাছে থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, নদীর পানি বৃদ্ধির আগে জিও ব্যাগের ডাম্পিং কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি ওই ঠিকাদার। আগস্ট মাসের শুরুতে নদীর পানি বৃদ্ধি শুরু হলে চরের বালি দিয়ে তড়িঘড়ি করে জিও ব্যাগ ভরা হয়। ভাঙনের স্থানে জিও ব্যাগ ফেলার আগেই অর্ধেকের বেশি জিও ব্যাগ পানিতে তলিয়ে যায়। ৯১ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কথা থাকলেও ভাঙনের স্থানগুলোতে মাত্র ৪১ হাজারের মতো জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।
ডাম্পিংয়ে ত্রুটির কথা স্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহী পওর বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আবু রৌশন মাসউদ বলেন, ডাম্পিং করার আগেই অনেক জিও ব্যাগ তলিয়ে গেছে। প্রায় ৪১ হাজার ব্যাগ আমরা পেয়েছি, সেগুলোরই বিল দেওয়া হবে।