সুনামগঞ্জ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৫৮ পিএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৭ পিএম
সুনামগঞ্জে ঘরের ভেতরে মা-ছেলের জোড়া খুনের ঘটনার মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের স্বজনদের। গত ২৯ অক্টোবর সুনামগঞ্জ শহরের হাছননগরে নিজের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন ফরিদা বেগম ও তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম। এ ঘটনায় নিহত ফরিদা বেগমের মেয়ে আনফা বেগম ইসলাম বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৪ জনের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় খুনের মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওই বাসার ভাড়াটে ফয়সাল আহমদকে প্রধান আসামি, সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া ছোট ছেলেকে দ্বিতীয় ও তাদের মা নার্গিস বেগমকে তৃতীয় আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশ নার্গিস বেগম ও তার ছোট ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে।
এদিকে মামলা নিতে তিন দিন দেরি করা, মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার না করে দ্বিতীয় আসামি সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া কিশোরকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে জবানবন্দি নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পুলিশের তদন্ত নিয়ে নিহতের স্বজনদের মনে দেখা দিয়েছে সন্দেহ। তাদের অভিযোগ, মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে।
মামলার বাদী আনফা বেগম ইসলাম মনে করেন, প্রধান আসামি ফয়সাল আহমদকে গ্রেপ্তার করলেই সব রহস্য উদ্ঘাটন হবে। নার্গিস বেগমের পরিবারের অন্য সদস্যরাও ‘মাস্টার মাইন্ড’ হিসেবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তার দাবি, কেবল আইফোন নয়, খুনিদের আরও বড় মোটিভ ছিল।
বুধবার প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আনফা বেগম ও তার ফুফাতো ভাই সজীব আহমদ ও রূপজ আহমদের। তারা জানান, অপ্রাপ্তবয়স্ক যে ছেলেটিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাকে পরিকল্পনা করে পরিবারের সদস্যরা সামনে আনতে পারে, অন্যরা রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা এই কাজ করতে পারে।
আনফা বেগম বলেন, আমার মা ও ভাইকে হত্যা করতে এবং পরবর্তীকালে খুনিদের রক্ষা করতে ঘটনার পর গ্রেপ্তার হওয়া নার্গিস বেগম, তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম, তাদের ইতালি প্রবাসী মেয়ে হাফিজা বেগম, সিলেটে থাকা মেয়ে মাহফুজা বেগমÑ সবাই বিভিন্নভাবে কাজ করেছে। এজন্য নার্গিস বেগমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার ছেলে ফয়সল আহমদকে গ্রেপ্তার করা জরুরি। খুনের ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল ফয়সাল আহমদ। সে ওইদিন রাতে এই বাসায়ই ছিল।
আনফা বেগমের ফুফাতো ভাই সজিব আহমদ বললেন, মামলাটি গভীরভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। খুনের সঙ্গে জড়িতরা পাঁচটি মোবাইল নিয়েছে, নার্গিস বেগমের মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে না। নার্গিস বেগমের মোবাইলসহ ওই মোবাইলগুলো উদ্ধার করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
সজিবের মতে, যে শিশুটি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে, সে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছে, খুনের ঘটনার পর সকালেই সিলেট থেকে বিমানে ঢাকায় গেছে সে এবং বিমানের টিকিটের টাকা বিকাশ করে বড় ভাই ফয়সাল পাঠিয়েছে তাকে, ওর কাছে যদি বিমানের টিকিটের টাকাই না থাকে, তাহলে ফুফুর (ফরিদা বেগমের) আলমারিতে থাকা নগদ টাকা কে নিয়েছে?
সজিব মনে করেন, তিনজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে বা আলাদাভাবে জবানবন্দি নিলেই রহস্য উদ্ঘাটন হবে।
সজিবের আরেক চাচাতো ভাই রূপজ আহমদ বলেন, খুনের ঘটনায় এবং খুনির বক্তব্য যা প্রচার হয়েছে, তাতে আরও কিছু রহস্যের জন্ম দিয়েছে, যেমন যে শিশুটি মিনহাজুল ও ফরিদা বেগমকে খুন করেছে তার শারীরিক শক্তি খুন হওয়া মিনহাজুলের চেয়ে অনেক কম। শারীরিক গঠনেও সে মিহাজুলের চেয়ে ছোট। ধস্তাধস্তিতে সে মিনহাজুলের সঙ্গে পারার কথা নয়। এ ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পিবিআইয়ের একজন সদস্য বলেছেন, আলামতে তারা বুঝতে পেরেছেন, মৃত্যুর আগে ফরিদা বেগম ও তার ছেলে মিনহাজুল দীর্ঘ সময় ধস্তাধস্তি করেছেন। তাহলে কি অন্য আরও কেউ ছিল। এ ছাড়া নার্গিস বেগমই-বা খুনের ঘটনার সময় শারীরিকভাবে কেন আহত হলেন না, তিনি ফেরানোর চেষ্টাও নিশ্চয়ই করেননি এমন কথাও সামনে এসেছে। সকালে নার্গিস বেগম হাসপাতালে কারও কারও সঙ্গে কথাও বলেছেন। সবকিছু মিলিয়ে বোঝাই যায়, খুনিরা ঠান্ডা মাথায় ঘটনা ঘটিয়েছে।
রূপজ আরও বললেন, তারা (খুনিরা) পেছনের দেওয়ালের ওপর দিয়ে পালাবার পথ আগেই করে রেখেছিল। দেওয়াল টপকে যাওয়া আটকানোর জন্য লোহা পোঁতা ছিল। এগুলো দুই ফুটের মতো সমান করে কেটে রাখা হয়েছে যাওয়া-আসার সুবিধার জন্য। সামনের দিকে সিসি ক্যামেরা সড়কেও আছে, এসপির বাংলোর সিসি ক্যামেরাও আছে, এজন্য ওদিকে তারা (খুনিরা) বেরোয়নি। এ ছাড়া খুন করার পর রক্তমাখা নিজেদের কাপড়চোপড় ধুয়ে গোসল করে খুনিরা বেরিয়েছে বলে আলামত দেখে পিবিআই বুঝতে পেরেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতের এক স্বজনের দাবি, মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ নানাবিধ তত্পরতা চালাচ্ছে। প্রধান আসামিকে বাঁচাতে এবং তাকে গ্রেপ্তার না করে দ্বিতীয় অভিযুক্ত এক কিশোরকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। প্রধান আসামিকে বাঁচানোর তৎপরতায় থানার আইও এবং ওসি জড়িত বলে সন্দেহ করেন তারা। খুনের সময় চুরি যাওয়া স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ নিজেই আত্মসাৎ করেছে বলে এলাকায় আলোচনা আছে। যে কারণে পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজসহ নানা আলামত ধ্বংস করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। খুন হওয়ার তিন দিন চলে গেলেও পুলিশ বিলম্ব মামলা নিয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই মামলার তদন্তভার সিআইডি বা পিবিআইর কাছে হস্তান্তর অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন নিহতের স্বজনরা।
পিবিআইয়ের সাব ইন্সপেক্টর সঞ্জয় লাল দেব বলেন, ঘটনার পর সকালে গিয়ে ঘরের মেঝে রক্ত ও লাশের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে ফরিদা বেগম ও তার ছেলে মিনহাজুল মৃত্যুর আগে লড়াই করেছেন, অর্থাৎ ধস্তাধস্তি হয়েছে। দুজনের বেশি খুনি ওখানে ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। পাশের কক্ষের চেয়ারের ওপরে ভেজা কাপড়চোপড় পাওয়া গেছে। অর্থাৎ খুনিরা গোসল করে পরিষ্কার হয়ে বের হয়েছে, এটা বোঝা গেছে।
সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া নার্গিস বেগমের ছোট ছেলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। নার্গিস বেগমের পাঁচ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
জেলা পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, খুনের রহস্য ইতোমধ্যে উদ্ঘাটন হয়েছে। মামলার আসামি ফয়সালকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় নিবিড়ভাবে কাজ করছে পুলিশ।
নিহত ফরিদা বেগমের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, খুনের সঙ্গে জড়িতরা বাসায় থাকা নগদ তিন লাখ টাকা, সাত থেকে আট ভরি স্বর্ণালংকার ও বিভিন্ন কোম্পানির পাঁচটি মোবাইল ফোন নিয়েছে।