লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩০ পিএম
সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের দখলে থাকা মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়ার পাঁচ একর জায়গা পুনরুদ্ধার করেছে বন বিভাগ।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। বিষয়টি অনেকটা ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ বাঙালি জীবনের বহুল শ্রুত এই প্রবাদের মতো। কারণ বর্তমানে কী পরিমাণ বনভূমি আছে তা জানে না খোদ বন বিভাগই। বিগত কয়েক দশকে বনের চারপাশের জমি যে যেভাবে পেরেছে দখলে নিয়ে সম্প্রসারণ করেছে চা-বাগান, তৈরি করেছে লেবু-আনারস-বাগান, কটেজ, বাড়িসহ নানা স্থাপনা। বনের জমি নিজেদের দাবি করে করেছে মামলাও। প্রভাবশালী মহলের বাধা, রক্তচক্ষু ও নানাবিদ কারণে বনটির আয়তন পরিমাপ করতে পারেনি বন বিভাগ। তারা জানে না ঠিক কতটুকু জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি শুরু করেছে উচ্ছেদ অভিযান।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বনটিকে সরকার ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করে। রেইন ফরেস্ট হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এ বন বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এ বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদসহ নানা জীবজন্তু। কিন্তু গত ২৮ বছরেও বনের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি বন বিভাগ।
স্থানীয়রা জানায়, জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার পূর্ব থেকেই বনটিতে দখলের থাবা বসিয়েছে আশপাশের কিছু বাসিন্দা। নিজেদের জমির সঙ্গে বনের জমি দখলে নিয়ে বাড়িঘর তৈরি ও লেবু-আনারস-বাগানের সীমানা বর্ধিত করলেও প্রকৃতপক্ষে দখলের মচ্ছব শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। পরের বছরই তিনি পূর্ণমন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ মনোনীত হন। সে সময় তিনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্পমূল্যে কিনে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তোলেন। অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নিজের কেনা স্বল্প জমির সঙ্গে লাউয়াছড়া উদ্যানের অনেকটা দখল করে চা-বাগানে যুক্ত করেছেন। সে সময় থেকেই বন বিভাগ বারবার জমি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েও করতে পারেনি। এরপর থেকেই মূলত লাউয়াছড়া বনভূমি দখলের উৎসব শুরু করে প্রভাবশালীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি দখল-বেদখলে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে প্রায় অর্ধেক আয়তনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকবার বনটি ডিমারকেশনের (পরিমাপ) চেষ্টা করেও পারেনি বন বিভাগ। এমনকি সম্ভব হয়নি দখলবাজদের উচ্ছেদ করা। কারণ দখলবাজরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ বা পতিত সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের প্রভাবের কারণেই বন ডিমারকেশন (পরিমাপ) করা যায়নি। তাদের (দখলবাজদের) ভয়ে বন বিভাগই থাকত তটস্থ।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বন বিভাগ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। শুরু করে বনের জমি উদ্ধার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে চা-বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করে। গত ৩ নভেম্বর কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বদরুল আলম জেনারের দখলে থাকা প্রায় চার একর ভূমি উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। সেখানে বন্য প্রাণীদের খাবার উপযুক্ত ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হয়।
বন বিভাগ যে চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে সে জমিতে লেবু চাষ করতেন শাহ আলম নামে একজন। তিনি শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি প্রতিবেদককে জানান, বদরুল আলম জেনারের কাছ থেকে ওই জমি পাঁচ বছরের লিজ নিয়ে লেবু চাষ করেছেন। অগ্রিম হিসেবে দুই বছরের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করার কথা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলগঞ্জের এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘‘রক্ষিত বন এলাকার সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সহব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও তেমনি কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বৃক্ষনিধন ও পাচার রোধ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের মাধ্যমে বনভূমির অব্যাহত বেদখল বা জবরদখল রোধসহ বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। কিন্তু কমিটির সদস্য থাকা অবস্থায় বদরুল আলম জেনার নামে একজন বনভূমি দখল করে নিয়েছেন। এ ছাড়া বনভূমি দখল করেছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদও। এককথায় বলা যায়, লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে ‘রক্ষকই ভক্ষক’। যারা বনভূমি দখল করেছিলেন প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’’
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ দখলদার ছাড়াও স্থানীয় তিন থেকে চারশ লোক বাদী হয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৩৭০ একর জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ও বন ডিমারকেশন না হওয়া পর্যন্ত ঠিক কতটুকু জমি অবৈধ দখলে রয়েছে, আর কতটুকু জমি বন বিভাগের আওতায় রয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন ডিমারকেশন (পরিমাপ) করা হবে। ডিমারকেশন সম্পন্ন হলে প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে।’
সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বনের জমি উদ্ধারের সময় কাউকে পাওয়া যায়নি। কেউ জমির মালিকানা দাবি করতেও আসেনি।’
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুই দফায় বনের নয় একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে বন্য প্রাণীর উপযোগী গাছের চারা লাগানো হয়েছে।’