গোফরান পলাশ, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০৭ এএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১০:১০ এএম
পুকুরের কোরাল হাতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলীর মৎস্যচাষি আনোয়ার হোসেন। প্রবা ফটো
সাগরের সুস্বাদু মাছ কোরাল, যার আরেক নাম ভেটকি। প্রজননের তাগিদে কোরাল সমুদ্র থেকে নদীতে এলেও আবার ফিরে যায় সাগরে। তবে অবাক হলেও সত্য, এই কোরাল এবার চাষ হচ্ছে পুকুরে।
পুকুরে কোরাল চাষের উদ্যোক্তা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের মৎস্যচাষি আনোয়ার হোসেন।
দেশি প্রজাতির কোরালের খাবার তেলাপিয়া, চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ। চাষিরা ঘেরে বা পুকুরে কোরাল চাষ করলে অন্যান্য প্রজাতির মাছ খেয়ে সাবাড় করত। ফলে চাষিদের লাভের বদলে গুনতে হতো লোকসান। তবে প্রথমবারের মতো রাক্ষসী প্রজাতির এই মাছ কৃত্রিম ফিড খাবারের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে পুকুরে।
প্রায় এক বছর আগে আনোয়ার হোসেন মাইটভাঙ্গা গ্রামে নিজের ৩০ শতাংশ পুকুরে কোরাল চাষ শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণার পর সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজের একদল গবেষক থাইল্যান্ড থেকে ৭ শতাধিক পোনা আমদানি করে তাকে সরবরাহ করেন। কোরালগুলোকে খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে গবেষকদের উৎপাদিত সিউইড সমৃদ্ধ কৃত্রিম ফিড খাবার। সঠিক পরিচর্যায় মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আনোয়ারের পুকুরের এক একটি কোরালের ওজন হয়েছে ৩ থেকে ৪ কেজি। এতে অনেকটা উচ্ছ্বসিত আনোয়ার। তার দেখাদেখি এখন অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন কোরাল চাষে। তবে বর্তমানে কক্সবাজারেই উৎপাদন হচ্ছে এসব কোরাল মাছের পোনা। কেউ চাইলে কক্সবাজার থেকে এসব কোরালের পোনা সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে পুকুরে কোরাল চাষের কথা কোনোভাবে চিন্তাও করতাম না। কোরাল রাক্ষসী মাছ। পুকুরে একটি দুটি কোরাল থাকা মানে অন্যসব মাছ শেষ। তবে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের পরামর্শে পুকুরে গত বছর কোরাল চাষ শুরু করি। তারা আমাকে থাইল্যান্ডের ৭ শতাধিক পোনা দিয়েছে। এখন আমার পুকুরের এক একটি কোরালের ওজন ৩ থেকে ৪ কেজি। খাবার হিসেবে এসব কোরাল মাছকে গবেষকদের উৎপাদিত ফিড খাবার এবং বাজার থেকে কিনে আনা ফিড খাবার দিয়ে থাকি।
মাইটভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা রহমান মিয়া বলেন, এটি আশ্চর্যের বিষয়। দেশি কোরাল ফিড খাবার খায় না। পুকুরের অন্যান্য মাছ খেয়ে কোরাল বেড়ে ওঠে। তবে আনোয়ার শুধু ফিড খাবার দিয়েই কোরাল বড় করে তুলেছে। পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে এ জাতের কোরাল চাষ করার ইচ্ছা আছে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ও সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড ফিশারিজ প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, উপকূলীয় এলাকায় কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল চাষ ছড়িয়ে দিতে দীর্ঘ গবেষণা হয়েছে। এসব মাছের খাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই মেশিনের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়েছে। এসব মাছের খাবারে সামুদ্রিক শৈবাল (সিউইড) ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে আমার দল কাজ করছে। ৫ গ্রামের কোরাল মজুদ পুকুরে ১ বছরে চাষ করে ২ থেকে ৩.৫ কেজি ওজনের হওয়ায় শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যচাষিদের কাছে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আমাদের উদ্ভাবিত সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ প্রযুক্তি বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
এ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক শরিফুল আজম বলেন, দেশে উৎপাদিত পোনা মূলত তৈরি খাবার না খাওয়ার কারণেই থাইল্যান্ড থেকে এসব পোনা আমদানি করা হয়েছে। তবে দীর্ঘ গবেষণার পর কৃত্রিম খাদ্যের কোরালের পোনা বর্তমানে কক্সবাজারের কয়েকটি হ্যাচারিতেও উৎপাদিত হচ্ছে। চাষিরা চাইলে সেখান থেকেও কোরালের পোনা নিয়ে আসতে পারবে। উপকূলীয় এলাকায় আমরা ফিড খাবারের কোরাল চাষ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছি। এটির পোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে বড় করা পর্যন্ত সফলতা পাওয়া গেছে।