হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
তিন বছর আগে ২০২১ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব পতাকাবাহী সামুদ্রিক জাহাজের বহর ছিল ৭৩টি। ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ১০১টিতে। দেশীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান নতুন করে জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে দেশীয় পতাকাবাহী সামুদ্রিক জাহাজের সংখ্যা। ২০৩০ সালের দিকে বাণিজ্যিক বহরে জাহাজের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রেখে আইন প্রণয়ন করাসহ জাহাজ আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) অব্যাহতি দেওয়ায় এখন নতুন নতুন শিল্প গ্রুপ জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। শিল্প গ্রুপগুলোর জাহাজ ব্যবসায় আসার এই ধারা অব্যাহত থাকলে ৫-৭ বছরের মধ্যে জাহাজের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যাবে।
নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ সরকারের নীতি সহায়তা। ২০১৯ সালের আগের আইন অনুযায়ী, আমাদের এখানে অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট দিতে হতো। ২০১৯ সালে এ শর্ত খানিকটা শিথিল হয়েছে। এখন ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। অগ্রিম আয়কর পাঁচ শতাংশ থেকে এখন এক শতাংশ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোকে জাহাজ কেনার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের আমদানি রপ্তানি কার্গো যাতে দেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলোতেই পরিবহন করা হয়, সেটি আমরা কঠোরভাবে মনিটরিং করছি। যার ফলে দেশি জাহাজে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখন শিল্প গ্রুপগুলো নিজেদের বহরে নতুন নতুন জাহাজ সংযোজন করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধিও এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। আমদানি পণ্য পরিবহনে খরচ বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই জাহাজে বিনিয়োগ করেছে। এসব কারণে করোনার সময় যখন জাহাজের দাম কমে যায়, তখনই সে সুযোগ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।’
প্রসঙ্গত, দেশীয় পতাকাবাহী ১০১টি বাণিজ্যিক জাহাজের মধ্যে সাতটি ছিল সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি)। বাকি ৯৪টি জাহাজ ব্যক্তিমালিকানাধীন। সম্প্রতি বিএসসির মালিকানাধীন ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুটি জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা পাঁচটিতে নেমে এসেছে। এদিকে বিএসসির মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা কমলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। গত তিন বছরে অন্তত ২৮টি বাণিজ্যিক জাহাজ দেশীয় পতাকাবাহী বহরে যুক্ত হয়েছে।
সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপে। গ্রুপটির বহরে এখন জাহাজ রয়েছে ২৪টি। ২০০৪ সালে জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখানো গ্রুপটি এক দশকের বেশি সময় ধরে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে গত তিন বছরে একের পর এক বিনিয়োগ করে এ তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)। গ্রুপটির বহরে বর্তমানে বাণিজ্যিক জাহাজ রয়েছে ২৩টি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম এমভি এটলাস শিপিংয়ের এমভি আল সালমা নামের একটি জাহাজে সমুদ্র পরিবহন শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে দেশীয় পতাকাবাহী ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক জাহাজের বহর। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি জাহাজ যুক্ত হয়েছে দেশীয় পতাকাবাহী বহরে। এই সময় অন্তত ১৩টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক জাহাজ ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে।
নৌবাণিজ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ওমেরা লিগ্যাসি নামে একটি অয়েল ট্যাংকার জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড। একই বছর অরিয়ন এক্সপ্রেস নামে একটি জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় অরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড। পরের বছর ২০১৯ সালে স্টার রয়েল নামে একটি জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় ভ্যানগার্ড মেরিটাইম। সেঁজুতি নামে একটি জাহাজ কিনে একই বছর প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় অ্যাডভান্স শিপিং। পরের বছর ২০২০ সালে এইচআর সাহারা নামে একটি কন্টেইনার জাহাজ কিনে প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় আসে কর্ণফুলী লিমিটেড শিপিং। ওই বছর জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে আরও সাতটি কন্টেইনার জাহাজ যুক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কর্ণফুলী লিমিটেডের মালিকানায় রয়েছে দেশের পতাকাবাহী ৮টি কন্টেইনার জাহাজ।
২০২১ সালে সুপার রয়েল নামে একটি জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় বিএসএ শিপিং লিমিটেড। এর পরের বছর ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় যুক্ত হয় চারটি গ্রুপ। এর মধ্যে জারার হানিফ, রুবাইয়াত হানিফ নামে দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো জাহাজ ব্যবসায় নাম লেখায় হানিফ মেরিটাইম লিমিটেড, অপরাজিতা নামে একটি জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে পিএনএন শিপিং, প্রাইড অব ইয়াসনা নামে একটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে সানশাইন নেভিগেশন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং একটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে এ ব্যবসায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় পিএইচ নেভিগেশন। এর পরের বছর ২০২৩ সালে ‘লেডি অব দরিয়া’ এবং ‘কুইন অব দরিয়া’ নামে দুটি অয়েল ট্যাংকার জাহাজ কেনার মধ্য দিয়ে জাহাজ ব্যবসায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় দরিয়া শিপিং লিমিটেড। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সামুদা নামে একটি অয়েল ট্যাংকার কিনে জাহাজ ব্যবসায় আসে সামুদা শিপিং লিমিটেড।