ফরিদপুর সংবাদদাতা
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২২ ০৯:০৮ এএম
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২২ ১২:১৩ পিএম
আলফাডাঙ্গায় কালের সাক্ষী ভবতারিণী কুটির। ছবি : প্রবা
মধুমতীর তীরঘেঁষা ছোট্ট একটি গ্রামের নাম চাঁদড়া। অজপাড়াগাঁয়ের ছোট্ট এ গ্রামটিতে কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ভবতারিণী কুটির। ফরিদপুরের দক্ষিণের শেষ প্রান্তে আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাঁচুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশে এর অবস্থান।
কালের সাক্ষী জমিদারবাড়িটি এলাকার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। স্থানীয় ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি এ জমিদারবাড়িটি সংরক্ষণ করে পর্যটক কেন্দ্রে রূপান্তরের।
১৯৩৫ সালে (বাংলা ১৩৪২ আশ্বিন) জমিদার গির্জাকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় ভবনটি প্রতিষ্ঠা করেন। লাল বর্ণের দোতলাবিশিষ্ট মূল ভবনের পাশে রয়েছে লাট্টু ঠাকুরের বাড়ি। ভবনটির সামনে দাঁড়ালে ব্রিটিশ আমলে চুন-সুরকি দ্বারা নির্মিত স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন আজও মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। ভবনটির প্রধান প্রবেশদ্বারে ফলকনামায় লেখা : জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী ভবতারিণী কুটির, ১৩৪২ আশ্বিন।
ভবনের নিচের তলায় রয়েছে বৈঠকখানা এবং ওপরে জমিদারের পারিবারিক শয়নকক্ষ। পূর্বে ওপরে ওঠার জন্য কাঠের হাতলবিশিষ্ট সিঁড়ি ছিল। বর্তমানে হাতল ভেঙে গেছে তবে সিঁড়ি দিয়ে এখনও উপরে ওঠা যায়। ১০ কক্ষবিশিষ্ট জমিদারবাড়িতে পাঁচটি দরজা ও ১৬টি জানালা আছে। ওপরতলায় লোহার রেলিং ও টিনের চালযুক্ত বারান্দা ছিল এখন তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ভবনের ওপরতলায় একটি লোহাড় সিন্দুক আছে যা সংরক্ষণের অভাবে মরিচা ধরেছে। বাড়ির মধ্যে একটি রান্নাঘর আছে। জমিদার গির্জাকণ্ঠ সম্পর্কে জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি ঝামার (মোহাম্মদপুর, মাগুরা) নায়েব ছিলেন। সেখান থেকে অনেক অর্থসম্পদের মালিক হলে চাঁদড়া গ্রামে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তার মুহুরি ছিলেন কেশবচন্দ্র চন্দ।
জমিদারের তিন ছেলের মধ্যে দুজনের নাম জানা গেছে। বড় ছেলে ব্যাচা মুখোপাধ্যায় এবং ছোট ছেলে শিবুপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সে সময় মধুমতী নদী ছিল জমিদারবাড়ির সামনে। জমিদারের বড় বড় নৌকা ছিল, নৌকাগুলো বাড়ির সামনের ঘাটে বাঁধা থাকত। গির্জাকণ্ঠ বাড়ির সামনে গ্রাম্য হাট চালু করেন। এখন আর সেই হাট বসে না। নদীয়ার চাঁদবাজারের পশ্চিম পাশ গির্জাকণ্ঠের নামানুসারে ‘গির্জার চর’ নামে পরিচিত।
জমিদারবাড়ির বাঁ দিকে একটি নারায়ণ মন্দির আছে। আগে মন্দিরটিতে পাথরের নারায়ণমূর্তি ছিল। এখন আর নারায়ণমূর্তি নেই এবং পূজাও হয় না। পাশেই ছিল দুর্গামন্দির, সেটিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মন্দিরটির ফলকনামায় বর্ণিত আছে : স্বর্গীয় পূজ্যপাদ মহাপুরুষ রামচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে তাহার দীন সন্তান মণিকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় দ্বারা এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হইল। ১৩৪৪ বৈশাখ মণিকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় গির্জাকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবেশী ছিলেন। আরেক প্রতিবেশী মণীন্দ্রনাথের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ এখনও চোখে পড়ে। জমিদারবাড়ির কিছু অংশ মধুমতীতে বিলীন হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিদার গির্জাকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় সপরিবারে ভারতে চলে যান। সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সরকার জমিদার গির্জাকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটি খাসজমি হিসেবে আলফাডাঙ্গা উপজেলা ভূমি অফিসের অধীনস্থ করে নেয়।
এলাকার সহকারী স্কুলশিক্ষক নৃপেন্দ্রনাথ বলেন, ‘এ কুটিরটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে এখনও মানুষ দেখতে আসে, ছবি তুলে চলে যায়। এটি এ এলাকার একটি পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন। সরকারের উচিত এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা।’
এ প্রসঙ্গে আলফাডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম জাহিদুল হাসান জাহিদ বলেন, ‘এটি এ অঞ্চল তথা আলফাডাঙ্গার একটি পুরনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। এটি রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’