সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪ ১১:১৫ এএম
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৪ ১১:১৮ এএম
সাবেক সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন। ফাইল ফটো
প্রভাবশালী এমপিদের মধ্যে অন্যতম কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন। এলাকায় তিনি দুর্নীতিবাজ ও ক্যাসিনো রাজা হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতায় থেকে আফজাল সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, এক সভায় মাইকে বক্তব্য দিতে গিয়ে এমপি আফজাল দলীয় এক চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলছেন, যদি তুমি আমার কথা না শোনো তবে, এক পাও আগাতে পারবা না, তুমি এলাকায় বসবাস করতে পারবা না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমপির ইশারা ছাড়া একটি গাছের পাতা এদিক থেকে ওদিকে যাবে না।
বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মাতার কার্ড তার দলীয় লোকজনকে না দিলে আফজাল হুঙ্কার ছেড়ে চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, তোমাকে একটা ফুঁ দিলে সিংপুর ইউনিয়ন শুধু নয়, বাংলার মাটিতে বাঁচার অধিকার তোমার নাই। এমপি আরও বলেন, পরিষ্কার ভাষায় আমি বলব, উনি (চেয়ারম্যান) যত কাজকাম করবেনÑ সকল কাজ আমাদের অধীনে হবে। আফজালের এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সারা বাজিতপুর-নিকলী উপজেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এমপি আফজাল ও তার ভাই শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
হত্যাসহ কয়েকটি মামলার আসামি আফজালকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন বাজিতপুরের শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক মো. আবদুল মান্নান স্বপনসহ এলাকার সচেতনমহল। আফজালের সমুদয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার দাবিও জানান তারা।
আবদুল মান্নান স্বপন বলেন, একটি পত্রিকায় প্রকাশিত আফজালের দুর্নীতির খবর এবং তার বক্তব্যের তদবিরের ভিডিওটি তিনি ফেসবুকে আপলোড করলে আফজাল তার নামে আইসিটি আইনে থানায় মামলা করেন। তাকে ধরার জন্য বাজিতপুর-নিকলীর ৭/৮টি গ্রামে সারারাত পুলিশ দিয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালান।
পর পর চারবার এমপি হন আফজাল, যদিও আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ তার ছিল না। ২০০৮ সালে তিনি প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। বাজিতপুর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের বিরোধিতার মধ্যেই তিনি টাকার জোরে মনোনয়ন পেয়ে যান।
এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, আফজাল আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালীকে অর্থের বিনিময়ে খুশি করে সংসদ সদস্য হওয়ার পথটি সুগম করেন। প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় তিনি বারবার মনোনয়ন বাগিয়ে নেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগী হয়ে ওঠেন তারই আপন ছোট ভাই আনোয়ারা হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে পরের বছর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তার ভাইকে মেয়র বানান।
বাজিতপুর পৌরবাসীর অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে পৌরসভায় একমাত্র ক্ষমতাধর দাবি করে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে দোকানপাট, খাসজমি, বাড়িঘর, জলমহাল, বালুমহাল দখলের অসংখ্য অভিযোগ এমপি ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে।
দুইটি উপজেলায় গিয়ে সরেজমিনে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে জেলার সবচেয়ে বড় জলহমাল বেঙ্গলা নদী জলমহাল দখল করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করেন। এমপির নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামমাত্র মূল্যে ইজারা নির্ধারণ করে দখল করেন। পৌর এলাকার ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় দুই একর জমি দখল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে দুই একর জমি, বসন্তপুর মৌজায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার ২০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় আট একর জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর সড়কের পশ্চিম পাশে ৬০ শতাংশ জমি শশেরদীঘি মৌজায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।
পাশাপাশি তার অনুগত ও আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এমপি ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল মিয়া নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজ বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দিয়ে তার ২৯ শতাংশ জমিও দখল করে নেন দুই ভাই। ভুক্তভোগী বিল্লাল মিয়া বলেন, তার জায়গা দখল করেছে দুই ভাই। তার জায়গায় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকার গাছ ছিল তা সবই নিয়ে গেছে। তার এই ভূমির মূল্য হবে দুই কোটি টাকা। বাজিতপুর পৌর এলাকার সিনেমা হল সড়কে একটি দোকানের মালিক চঞ্চল। তার দোকানও দখল করে নেন আফজাল ও তার ভাই আশরাফ। ভুক্তভোগী চঞ্চল জানান, তার দোকান ৩ বছর তালা মেরে রেখেছিল। অনেক চেষ্টার পরও দোকানটা উদ্ধার করতে পারিনি। ৫ আগস্টের পর দোকানটা দখলমুক্ত হয়েছে।
তা ছাড়াও আফজালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অপ্রদর্শিত সম্পদ হিসেবে তার রয়েছে সেগুনবাগিচায় দুটি ফ্ল্যাট, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি করে প্লট, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি। এর বাইরে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা।
বাজিতপুর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) কার্যালয়ে মো. কামাল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলন করে আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনেন। আফজাল হোসেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও গুলিস্তানে ঢাকা ট্রেড সেন্টারে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ী।
ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে আফজালের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
সেই সময় দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা আফজালের সঙ্গে হোটেল রাজমণি ঈশা খাঁ, ফুয়াং ক্লাব, পুরান ঢাকার কয়েকটি বাড়িতে নিয়মিত আসর বসানোর কাজটি পরিচালনা করেন আফজাল হোসেন। আফজাল রাষ্ট্রের শীর্ষ কারও নাম ভাঙিয়ে অবাধে অপকর্ম চালিয়ে গেছেন। এ কারণে ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্যরা একসময় মনে করতেন, এসব অবৈধ কাজে আফজালকে সঙ্গে রাখলে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক তার ফেসবুক আইডি থেকে আফজালের সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকসংক্রান্ত একটি সংবাদ শেয়ার করেন। পরে আনোয়ারুল হককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়।
বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি এহসান কুফিয়া বলেন, দেশের সবচেয়ে সন্ত্রাসী জনপদ হিসেবে পরিচিত ও চিহ্নিত উপজেলা বাজিতপুর। তারা দুই ভাই মিলে বাজিতপুরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করায় বাজিতপুর হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম সন্ত্রাসী উপজেলা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এমপি আফজাল হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তা রিসিভ হয়নি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
কিশোরগঞ্জ দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে এখনও কোনো ফাইল খোলা হয়নি। সার্বিক বিষয়ে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয় বলতে পারবে। আর তার ভাই আনোয়ারের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তার সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, তাদের আইনগত কাজ ও অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।