বগুড়া
মোহন আখন্দ, বগুড়া
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৫০ পিএম
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৫০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরপরই বগুড়ায় ‘কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক’ স্থাপন প্রকল্পের ফাইলটি বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নেওয়া এক হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিসিকের পরিচালনা পর্ষদে মীর শাহে আলম নামে বগুড়ারই এক বিএনপি নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তিনি কাজও শুরু করে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বগুড়ায় ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানেরও আগ্রহ রয়েছে।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত বগুড়ার উন্নয়নে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বড় ধরনের অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পগুলোর অন্যতম ছিল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বিসিকের ‘দ্বিতীয় শিল্পনগরী’, ‘শিল্পপার্ক’, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’, ‘বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ’ নির্মাণ এবং বগুড়া জেলা সীমানায় করতোয়া নদী খনন ও যমুনা নদীর নাব্য ফেরাতে ড্রেজিং। তবে এর মধ্যে শুধু বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্প ছাড়া আর কোনো প্রকল্পই চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। কারণ বিগত সরকারের নীতিনির্ধারকরা বগুড়াকে বরাবরই ‘রাজনৈতিকভাবে নেগেটিভ জোন’ হিসেবেই বিবেচনা করতেন। আর সে কারণেই নানা অজুহাতে প্রকল্পগুলো বছরের বছর ধরে ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ একনেকে অনুমোদিত হওয়ার বড় কারণ ছিল এই প্রকল্পের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সবগুলো জেলার বাসিন্দাদের স্বার্থ জড়িত।
প্রায় ৬০ বছর আগে বিসিকের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি মৌজায় সাড়ে ১৪ একর জায়গা নিয়ে ‘শিল্পনগরী’ স্থাপন করা হয়। তবে ব্যাপক চাহিদার কারণে ১৯৮০ সালে তার আয়তন আরও পৌনে ১৯ একর সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু বর্ধিত শিল্পনগরীর প্লটগুলোও দ্রুত কলকারখানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মূলত তার পর থেকেই স্থানীয় উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনের জন্য জায়গা চেয়ে বিসিকের কাছে ধরনা দিতে শুরু করেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিসিক কর্তৃপক্ষ শহরের ছয়পুকুরিয়া এলাকায় ভারী শিল্পের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (বিএসইসি) নামে ১৯৮১ সালে অধিগ্রহণ করা ১৫ একর জায়গায় দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী গড়ার প্রস্তাব করেন। পরে ২০০৫ সালে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা বিএসইসিতে পাঠানোও হয়। কিন্তু বিএসইসি কর্তৃপক্ষ বিসিকের সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বাধ্য হয়েই ফসলি জমিতে শিল্প-কলকারখানা স্থাপন শুরু করেন। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমতে থাকে, তেমনি পরিবেশদূষণও বেড়ে যায়। ফলে বিসিক কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে আবারও দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনে নতুন করে উদ্যোগ নেয়। এজন্য তারা প্রথমে শহরের পূর্বদিকে সাবগ্রাম এলাকায় জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করে। কিন্তু সেটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। একপর্যায়ে বিসিক কর্তৃপক্ষ তাদের উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা থেকে বগুড়ায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী প্রকল্প বাদ দেয়।
পরবর্তীকালে বিসিকের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে বগুড়ায় ‘উত্তরাঞ্চল কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক’ স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের খাদাশ ও শালিখা মৌজায় ৩০০ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। ওই শিল্পপার্কটিতে মোট ৬৪০টি প্লট নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণসহ মোট ব্যয় ধরা হয় ৯২০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পরে ডিপিপি প্রণয়নের পর প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় সেটি আটকে থাকে। বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন বিসিকের দ্বিতীয় শিল্পনগরী কিংবা শিল্পপার্ক প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি; সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিকের দায়িত্বশীল এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গত সরকারের শাসনামলে বগুড়ার নাম শুনলেই নীতিনির্ধারকরা অসন্তুষ্ট হতেন। আর সে কারণে প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেকে নেওয়া সম্ভব হতো না।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়ায় বিসিকের শিল্পপার্ক স্থাপন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়েছে বলেই মনে করেন কৃষি যন্ত্রাংশ বাজারজাতকারী সংস্থা বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল মেশিনারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বামমা) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজেদুর রহমান রাজু। তিনি বলেন, এবার আমরা আশাবাদী। শুনেছি শিল্পপার্ক প্রকল্প নিয়ে বিসিক তোড়জোড় শুরু করেছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা থাকবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
বিসিকের নবনিযুক্ত পরিচালক মীর শাহে আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অতীতে রাজনৈতিক কারণে প্রকল্পটি ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রকল্পটি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। প্রতিবেদন পেলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’