শাখাওয়াত হোসেন সোহান, রাজবাড়ী
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১২:২৯ পিএম
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:২২ পিএম
গ্রাফিক্স প্রবা
হাওলাতি টাকায় এমপি হয়েই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমকে। পাঁচবারের এই এমপি স্ত্রী-সন্তান ও সাগরেদদের নিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার কমিশন, ঠিকাদারি কাজ, বালু উত্তোলন, জমি দখল, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়ে দুই হাতে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সম্পদ-সম্পত্তির হিসাব গোপন করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দেওয়ার পরও কয়েকবার জেলার শীর্ষ করদাতার পুরস্কার হাতিয়ে নিয়েছেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী ও তার পুত্র।
এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও রেহাই পায়নি সাবেক এই রেলপথমন্ত্রীর নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে। প্রতিপক্ষের ওপর সন্ত্রাস চালাতে তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিম গড়ে তোলেন হাতুড়ি বাহিনী। তাদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এতই বিস্তৃত যে, এই সাবেক মন্ত্রীর বাড়ির কাজের লোকও হয়েছে কোটি টাকার মালিক।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম ও তার পরিবারের সদস্যরা। ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিম ও স্ত্রী সাহিদা হাকিমের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজবাড়ী-২ আসন (পাংশা-বালিয়াকান্দি ও কালুখালী) থেকে ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জিল্লুল হাকিম এমপি হন। ওই আসনে মোট ছয়বার নির্বাচন করে পাঁচবার এমপি হন তিনি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর মাত্র ৫০ হাজার টাকা ঋণখেলাপির কারণে তার মনোনয়ন বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতার কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে একটি ভাঙা মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রচারাভিযান চালিয়ে বিজয়ী হন তিনি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
যত সম্পদ জিল্লুল পরিবারের
সাবেক এমপি জিল্লুল হাকিম তার স্ত্রী ও ছেলের নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। রাজধানীর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ৮/এ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জমির ওপর ৫০ কোটি টাকা মূল্যের সাততলা ভবন, সেটির সামনেই পাঁচ কাঠার আরও একটি প্লট, রাজধানীর বনানী সুপার মার্কেটের পেছনে অর্চার্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সিঙ্গাপুরে ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট এবং জাপানেও তার বাড়ি রয়েছে।
সরকারি জেলা পরিষদের ১৩ শতাংশ জায়গা ও সংখ্যালঘুদের ২০ শতাংশ জমি নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে পাংশা পৌর শহরের স্টেশন বাজারের সামনে মোট ৩৩ শতাংশ জমির ওপর জিল্লুল হাকিম তার বাবার নামে মাহমুদ প্লাজা নামে চার তলা মার্কেট নির্মাণ করেছেন। একই উপজেলার পারনারায়ণপুর মৌজায় পারনারায়ণপুর মসজিদের পাশে ২০ বিঘা জমিতে রয়েছে আম-বাগান বাড়ি। নারায়ণপুরে নিজের বাড়ির সামনেই ১২ শতাংশ জমি কিনে সেখানে তিনতলা ভবন নির্মাণ করছেন তিনি। রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় স্ত্রী সাহিদা হাকিমের নামে কিনেছেন বসুন্ধরা সিনেমা হলের ৪২ শতাংশ জমি। আবার ওই জমির সামনেই সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে তুলেছেন বাউন্ডারি ওয়াল।
২০১২ সালে কালুখালী উপজেলা পরিষদের পাশে মহিমশাহী চাঁদপুর মৌজায় সাবেক রেলমন্ত্রী ৬ বিঘা জমি নিজের নামে কেনেন। বালিয়াকান্দি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চামটা, দেওকোল মৌজায় ১২টি পরিবারের ১০৭ বিঘা জমি নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে নেন। পাশেই তালতলা এলাকায় সংখ্যালঘু গোবিন্দ পরিবারের ওপর নির্যাতন করে প্রায় ৬০ বিঘা জমি প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতা বারেক বিশ্বাসের নামে, তার পরে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন তিনি। তার ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিলাসবহুল টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, প্রাডো ভি-৮, পাজেরো ভি-৬, নোয়া মাইক্রোবাস, টয়োটা মাইক্রোবাসহ ৬টি গাড়ি। এ ছাড়াও রাজবাড়ী সদর, বালিয়াকান্দি, কালুখালী, পাংশা, রাজধানী ঢাকা ও বিদেশে নামে-বেনামে তার সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে।
পদ্মা ও গড়াই থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন
পাংশা উপজেলার চর আফড়া, কালুখালী উপজেলার গৌতমপুর, হরিণবাড়িয়া এলাকার অন্তত অর্ধশতাধিক স্পটে এমপি পুত্র মিতুল হাকিম ও তার ক্যাডার তোফাজ্জেল, ফজলু মেম্বার, জনি, মারুফসহ বেশ কয়েকজন বালু উত্তোলন করে। কালুখালীর চরপাতুরিয়া গড়াই নদের বালুমহাল থেকে সাওরাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম আলী, মৃগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম.এ মতিনের নেতৃত্বে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়। অভিযোগ, এসব স্থান থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ লাখ টাকার বালু বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন মিতুল হাকিম ও সাহিদা হাকিম। ২০২৪ সালে পাতুরিয়া গড়াই নদের বালুমহাল টেন্ডার ছাড়াই দখল করে বালু উত্তোলন করা হয়। এতে সরকার হারায় রাজস্ব।
জাপান পাঠানোর নামে প্রতারণা
জিল্লুল হাকিমের ছোট ভাই আবু নাসের হাকিম জাপানে ব্যবসা করেন। অভিযোগ, জিল্লুল হাকিমের ছেলের ‘মিতুল ট্রেডিংয়ের’ নামে শতাধিক যুবকের কাছ থেকে জাপান পাঠানোর নামে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদের সরকারি অর্থায়নে জাপানে ফ্রি পাঠানোর কথা ছিল।
ওই সময়ে জাপান যাওয়া একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সরকারিভাবে জাপান পাঠানোর কথা থাকলেও জিল্লুল হাকিম আমাদের কাছ থেকে জাপানে যাওয়ার জন্য ১০-১২ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। প্রথমে ৫ জনকে পাঠান। পরে কয়জনকে পাঠান জানি না। তবে অনেকেই টাকা দিয়ে ফেরত পাননি।
স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্য
পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলায় শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিমের বিরুদ্ধে। জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজ, মীর মশাররফ হোসেন কলেজ, জাহানারা বেগম কলেজ, নারুয়া লিয়াকত আলী কলেজ, বালিয়াকান্দি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সভাপতি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করে প্রায় দুই শতাধিক নিয়োগ দিয়ে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ তিনটি উপজেলার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে জনবল নিয়োগ দিতে হলেই এমপির শরণাপন্ন হতে হতো। বিএনপিপন্থি কিছু লোক আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তিনি তাদের নিয়োগ দেন।
সরকারি নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্য
তিনটি উপজেলার সাব রেজিস্ট্রি অফিস, সরকারি হাসপাতাল, এলজিইডির টেন্ডার, হাট-বাজার ইজারা, খেয়াঘাট ও জলমহাল ইজারা সবই নির্ধারিত হতো জিল্লুল হাকিমের কথায়। এলজিইডির ঠিকাদারি কাজ নিতে হলে আগেই জিল্লুল হাকিমকে ১৫% কমিশন দিয়ে আসতে হতো। টিআর, কাবিখা, কাবিটা, বিশেষ বরাদ্দ, ইজিপিপি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা তিনি কাজ না করেই হাতিয়ে নিয়েছেন। কালুখালী উপজেলায় একদিনে প্রায় চার শতাধিক ওয়াজ মাহফিল ও নামযজ্ঞানুষ্ঠানের নামে ৪০০ মেট্রিক টন চাল জিল্লুল হাকিমের নেতৃত্বে হাতিয়ে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের জুনের আগেই তিনটি উপজেলাতে তিন কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জিল্লুল হাকিম ও তার ক্যাডারদের বিরুদ্ধে।
দলীয় নেতাকর্মী নির্যাতন
জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, দলের ত্যাগী নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিজের পছন্দের প্রার্থী ঘোষণা, পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ীসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। রাজবাড়ী জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি ও পাংশা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাদের মুন্সীসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৭ নেতাকর্মী খুনের ঘটনার ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জিল্লুল হাকিমের অন্ধ ভক্ত না হওয়ায় পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাসান আলী বিশ্বাস, সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর, সাবেক বন ও পরিবেশ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ আহমেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চিত্তরঞ্জন কুন্ডু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান, যুবলীগের সাবেক সভাপতি দিবালোক কুন্ডু জীবন, বাহাদুরপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোহন মুন্সী, ছাত্রনেতা ইদ্রিস মণ্ডল, বালিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশিদ, নারুয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুস সালামসহ অনেকেই পদ হারিয়েছেন। কালুখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম, সাবেক আহ্বায়ক মো. আবুল হোসেন মোল্লা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামছুল আলম, বালিয়াকান্দির বহরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খানসহ অনেকেই পদবঞ্চিত হয়েছেন।
এ ছাড়াও কালুখালীর বেতবাড়িয়া গ্রামের যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলামকে হত্যা, পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদকে হত্যার চেষ্টা এবং পাংশা উপজেলার সুবর্ণখোলা গ্রামের খলিলুর রহমান খানকে পিটিয়ে জখম করে এই এমপির সন্ত্রাসী সহযোগীরা এবং তার ছোট ভাই স্কুলশিক্ষক আসাদুল খানকে পিটিয়ে হত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে কালুখালী উপজেলার মোহনপুর গ্রামের ভ্যানচালক আব্দুর রহিম, কালুখালী উপজেলার কালিকাপুরের কৃষকলীগের সহসভাপতি মো. আমজাদ, পাংশা উপজেলা যুবলীগের সদস্য আবু হাসান হাবু, মৌরাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন মেম্বার, কালুখালীর সাওরাইল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মিয়াসহ অনেককে হত্যার নেপথ্যে রয়েছে জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে মিতুল হাকিম এবং তার ক্যাডার বাহিনীর ইন্ধন। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় কালুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেওয়া হয়। মদাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম মৃধা, সাওরাইলের আওয়ামী লীগ নেতা রাকিবুল ইসলাম আকমল খানকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে তার ক্যাডাররা। এ রকম শতাধিক নেতাকর্মীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়াসহ হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে এই এমপি বাহিনী।
জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবন
কালুখালী উপজেলার খাগজানা উচ্চ বিদ্যালয়, রতনদিয়া রজনী কান্ত উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদ আলী একাডেমি, পাতুরিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ধামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়, কালুখালী মেধা চয়ন একাডেমি, গোপালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাংশার বহলাডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়, সরিষা প্রেমটিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাংশা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইয়াকুব আলী বিদ্যাপীঠ, পাটিকাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজ, হাবাসপুর কে রাজ উচ্চ বিদ্যালয়, যশাই উচ্চ বিদ্যালয়, পাংশা জর্জ হাই স্কুল, পাংশা সরকারি কলেজ, বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজ, বহরপুর কলেজ, জামালপুর কলেজের ভবনগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম একাডেমিক ভবন নামকরণ করা হয়েছে। পাংশার ইয়াকুব আলী বিদ্যাপীঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম ভবন নামকরণ করা হয়েছে। বালিয়াকান্দি, পাংশা ও কালুখালী উপজেলার অর্ধশতাধিক ভবনের নামকরণ করেছেন।
মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার মজনুও কোটি টাকার মালিক
রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের বাসার কেয়ারটেকার হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান মজনু। দুই যুগ ধরে মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করার পর জেলা পরিষদের সদস্য হন তিনি। তারপর দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে ইউপি নির্বাচনে মন্ত্রীর প্রভাবে কালুখালীর মদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন। তার হাতে তিনটি উপজেলার বহু নেতাকর্মী নাজেহাল ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং পুলিশ কনস্টেবল, বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরানো-ছাড়ানোসহ নানা উপলক্ষে তিনি হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, কোটি টাকা ব্যয়ে কালুখালীর চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ডে চারতলা বিলাসবহুল ভবন, গ্রামে বিল্ডিং, মাঠে প্রায় ২০ বিঘা জমি ইত্যাদি সম্পদ গড়েছেন তিনি। মজনু ছিলেন মিতুল হাকিমের হাতুড়ি বাহিনীর প্রধান।
কুক্ষিগত করেছেন দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি
২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও ২ মার্চ কমিটি অনুমোদিত হলেও আর কোনো সভা হয়নি। জেলা আওয়ামী যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০২৩ সালের ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। তখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হলেও পরে এটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০২৩ সালের ২১ জুলাই বিকালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এটিও পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ দেখেনি। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মহিলা আওয়ামী লীগ রাজবাড়ী জেলা শাখা ঘোষণা করা হয়। এটিরও কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। ছয় বছর পর রাজবাড়ী জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন বা ঘোষণা আর করা হয়নি। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি জেলা কৃষক লীগের বর্ধিত সভা থেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হলেও সম্মেলন আর হয়নি। সাবেক রেলমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণেই সম্মেলন ও কমিটি গঠন নিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
জিল্লুল ও তার স্ত্রী-সন্তানের ওপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
গত ১৭ অক্টোবর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, তার স্ত্রী সাহিদা হাকিম ও ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. জিনাত ইসলামের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ
পাংশার নারায়ণপুরের খন্দকার নজরুল ইসলামের ছেলে বিপ্লব খন্দকার জানান, তাদের বাপ-দাদার ভোগ দখলীয় প্রায় শতবর্ষী জমিতে থাকা একটি আধুনিক মানের হোটেল প্রকাশ্যে রেলওয়ের লোকজন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে রেলওয়ের লোকজন ৫ কোটি টাকা দাবি করে। পরে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম প্রকাশ্যে মিটিংয়ে এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। আরও ঘর ভাঙার ঘোষণা দেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে একটি ঘরও আর ভাঙা হয়নি।
পাংশা উপজেলার সাবেক যুবলীগ নেতা দিবালোক কুণ্ডু জীবন বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করার পরও আমার নামে হত্যাচেষ্টাসহ নানা মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে সাবেক এমপি শেষ করে দিয়েছেন। আমি বিচার দাবি করছি।’
পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমার দুই হাত, দুই পা ভেঙে ও কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। আমি হামলাকারীদের বিচার দাবি করছি।’
পাংশার বন্দনা রানী বলেন, ‘আমাদের জমি দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে দখলে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সাবেক রেলপথ মন্ত্রীর বাসায় আমার শাশুড়িকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন দিন পর ফেরত দেওয়া হয়। পরে আবার আমাকে রাত ১২টার সময় গম গোবিন্দের গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সাবেক রেলপথমন্ত্রীর চাচাতো ভাই রুমি হাকিমের উপস্থিতিতে হুমকি দেওয়া হয়। পরে আমাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, লুটপাট করা হয়। এসবের কি বিচার হবে না?’
কালুখালীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে নৌকা মার্কায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার দাপটে মাঠে নামতে পারিনি। পরে মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। বিএনপির লোকজনকে দলে নিয়ে রাজবাড়ী-২ আসনে আওয়ামী লীগের অন্তত ৪২ নেতাকর্মীকে নির্যাতন করাসহ হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে এমপি ও তার বাহিনী। অনেকে তার ভয়ে বাড়িছাড়া হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর তারা এলাকায় ফিরে এসেছে।’
জিল্লুল হাকিম, তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল ও স্ত্রী সাহিদা হাকিম পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।