ময়মনসিংহের বন্যা
নাজমুস সাকিব, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১৬ এএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১১:১৩ এএম
ময়মনসিংহের ধোবউড়ার খড়িয়া গ্রামে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমন ফসল। প্রবা ফটো
বন্যায় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ফুলপুর, ধোবাউড়া এ তিন উপজেলায় আমন ধানের ৩১ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন উপজেলায় ফসল নষ্ট হয়েছে ৮৯ হাজার ৫৫০ জন কৃষকের। অনেক কৃষক পরিবারে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিন উপজেলায় তলিয়ে গেছে বাণিজ্যিক মাছ চাষের ১৫ হাজার পুকুর। প্রায় ৮৬ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে মাছের খামারিরা।
ধান চাষের জন্য শ্রেষ্ঠ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ফুলপুর ও ধোবাউড়া উপজেলা। এ অঞ্চলের মাটি কৃষির জন্য উর্বর হওয়ায় প্রতি বছর প্রচুর ধান উৎপাদন হয়। এ তিন উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন ধানের ৩১ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমি। ধারণা করা হচ্ছে, ফসল নষ্ট হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে অনেক কৃষকের পরিবারে।
ধোবাউড়া উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের বাতিহালা গ্রামের কৃষক আবদুল হাই। ছেলে-মেয়ে-নাতিসহ নয় জনের পরিবার। চলতি বছর তিনি ৬০ হাজার টাকা খরচায় ৫০ কাঠা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘গত রবিবার থাইকা সবগুলা ক্ষেত পানিতে তলায়া গেছে। থাহার ঘরেও পানি আছিল পাঁচ দিন, এহনো বাড়ির চারদিকে পানি। বন্যা আমার সব শেষ কইরা দিলো। প্রতি বছর নিজের পরিবারের চাহিদা মিডায়া অতিরিক্ত ধান বিক্রি করতাম। এইবার নিজেরাই ভাত খাইবার পাইতাম না।’
ফুলপুর উপজেলার বাটপাড়া গ্রামের কৃষক হরমুজ আলীর চারজনের ছোট পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। অন্যের জমিতে ধান চাষ করে সংসার চলে তার। এ বছর ১৮ হাজার টাকা খরচ করে ১২ কাঠা জমিতে হরি ধানের আবাদ করেছিলেন। ধানের শিষ বের হচ্ছিল, কিন্তু আকস্মিক বন্যায় সব শেষ তার। আক্ষেপ করে হরমুজ আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘একটা মাস পরেই ধান ঘরে তুলবার পাইতাম। অভাবের সংসারে একবারে শেষ বেলায় আইসা বন্যা আমারে নিঃস্ব কইরা দিলো। এখন স্ত্রী আর দুইডা মাইয়া লইয়া কেমনে চলাম।’
আব্দুল হাই আর হরমুজ আলীর মতো হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় বন্যার পানিতে ফসল নষ্ট হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক কৃষক। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, হালুয়াঘাট উপজেলায় আমন আবাদ করা হয়েছিল ২৪ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে। পানিতে তলিয়ে গেছে ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২৯ হাজার ৮০০ জন কৃষক। ধোবাউড়ায় ১৩ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমির আমন ধান চাষ করা হয়েছিল। বন্যার পানিতে ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৩ হাজার ২৫০ জন কৃষক। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ফুলপুরে ২২ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করলেও তলিয়েছে ৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমির ধান। এ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন কৃষক। এতে প্রায় ৪৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাম্মৎ নাছরিন আক্তার বানু জানান, কৃষকদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। পানি নেমে যাওয়ার পর বোরো মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ধান, সরিষা ও অন্যান্য ফসল আবাদের ব্যবস্থা করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানান তিনি।
তিন উপজেলায় বানের পানিতে তলিয়ে গেছে বাণিজ্যিক মাছ চাষের অনেক পুকুর। পানিতে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বন্যাকবলিত এই অঞ্চলের মৎস্য খামারিরা।
ধোবাউড়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল মোতালেব আকন্দ। অবসরের পর ধোবাউড়ার খড়িয়া এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে ১৩টি পুকুর খনন করে মাছ খামার শুরু করেন। রোববার বন্যার পানিতে ৬টি পুকুর তলিয়ে যায়। এতে প্রায় ১৫ লাখ টাকার শিং, মাগুর, পাঙাশসহ দেশীয় মাছ ভেসে গেছে। তিনি ২২ একর জমিতে ৭ লাখ টাকা খরচ করে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। বন্যার পানিতে নষ্ট হয়েছে ১৮ একরের ফসল। আব্দুল মোতালেব আকন্দ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এক রাতেই সব ভেসে গেছে, প্রতিরোধ করার সময়টুকুও পাইনি। আমার ধান গেছে, মাছও গেছে। বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া মাছগুলো মানুষ বড়শি ও বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে ধরতেছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার নাই।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, হালুয়াঘাট উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ৬ হাজার ১৫০টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ১ হাজার ১২০ মেট্রিক টন বিভিন্ন জাতের মাছ এবং ৫০ লাখ মাছেন পোনা। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২৪ কোটি টাকা। ধোবাউড়ায় ৭ ইউনিয়নে ৪ হাজার ২৯৬টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ২ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন বড় মাছ এবং ১২ লাখ পোনা। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। ফুলপুর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ৪ হাজার ৫০০টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন বিভিন্ন জাতের মাছ এবং ১ কোটি ৫০ লাখ পোনা। এতে প্রায় ২৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, এ বছর বন্যায় মৎস্য খাতে জেলার তিন উপজেলায় প্রায় ৮৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। আমরা সার্বিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়েছি। প্রণোদনার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে।