সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৪৫ পিএম
কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলায় কাশোরারচরে কৃষকদের ভাসমান সবজি চাষের বেড। দিনদিন যা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। প্রবা ফটো
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় কাশোরারচর বিলের দিকে তাকালে মনে হবে, গোটা বিলটাই যেন একটা সবজিক্ষেত। এখানকার কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন। যার মাধ্যমে অর্ধশতাধিক কৃষকের ঘরে ফিরেছে সচ্ছলতা। তাদের দেখাদেখি আশপাশের এলাকার কৃষকরাও এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে ঝুঁকছেন।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর বিলের পানিতে কয়েক বছর আগেও ছিল শুধু কচুরিপানার আধিক্য। এখন সেই কচুরিপানা ব্যবহার করে তার মধ্যেই বিষমুক্ত উপায়ে শাকসবজির পরিপাটি বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। দূর থেকে তাকালে মনে হয়, পানিতে বিছানো কোনো সবুজ গালিচা।
স্থানীয়রা জানান, কাশোরারচর বিলের নিচু জমিসহ পতিত স্থানগুলোয় বছরজুড়েই পানি থাকে। ফলে চাষাবাদের সুযোগ না থাকায় বছরের অধিকাংশ সময় পরিত্যক্ত পড়ে থাকে জমিগুলো। সেই পরিত্যক্ত জমিই এখন সবজিক্ষেত হয়ে উঠেছে।
কৃষকরা জানান, ফসলি জমি ও পতিত জলাশয়গুলোয় তারা প্রথমে কচুরিপানা দিয়ে বেড তৈরি করেন। এরপর বিভিন্ন সবজির চারা ও বীজ বপন করা হয়। এসব বেডে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। এসব সবজি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেই তারা বেশ লাভবান হচ্ছেন। কীটনাশক ব্যবহার না করায় তাদের উৎপাদন খরচও কম। ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু জায়গায় বসানো হয়েছে ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’। সার ও কীটনাশক ছাড়া উৎপাদিত সবজি কিনতে শহর থেকেও লোকজন আসেন।
জানা গেছে, ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা ফসল চাষ, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিস এ বছর মহিনন্দ ও কলাপাড়া ব্লকে ৭৩টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেছে। এরই অংশ কাশোরারচর বিলের ভাসমান সবজি বাগান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিলের এক একর পরিমাণ জায়গায় পানির ওপর কৃষকরা তৈরি করেছেন ২০০টি বেড। প্রত্যেকে কাজ বণ্টন করে নিয়ে সবজি বেডের পরিচর্যা করেন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ পানিতে নেমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই বিলে সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রথমে হাতে গোনা কয়েকজন বেডে সবজি আবাদ করলেও বর্তমানে ২৫ পরিবার বিলের এক একর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, ভাসমান বেডে ৭ থেকে ১০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চাষের ফলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়, কীটনাশক লাগে না, জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একবার বেড তৈরি করলেই সারা বছর সেখানে খুব সহজেই সবজি চাষ করা সম্ভব। লাউ, শসা, করলা, মিষ্টি কুমড়াÑ এ চার ধরনের সবজি চাষ করা যায়। এ ছাড়াও লালশাক, ডাঁটা, ঢেঁড়সসহ অন্যান্য সবজিও চাষ করা যায়। তেমন সারের প্রয়োজনও হয় না।
চংশোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা কৃষক হেলাল মিয়া বলেন, কাশোরারচর বিলের পতিত ভূমিতে এক যুগ ধরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করছি। সবজি বিক্রির টাকায় পরিবারের খরচ মেটাই। আমাদের দেখাদেখি বর্তমানে অনেকেই এভাবে আবাদ করছেন।
একই এলাকার কৃষক খাইরুল মিয়া বলেন, আমার কিছু জমি বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা থাকত। সেই জমিগুলোতে এখন ভাসমান বেড তৈরি করে শসা, লালশাক, ঢেঁড়স ও লাউ চাষ করছি। ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে এ সারমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি থাকায় অল্প খরচে বেশি লাভ হয়।
কৃষক হারিছ উল্লাহসহ আরও কয়েকজন জানান, তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় তারা ভাসমান পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম সবজি চাষ শুরু করে লাভবান হয়েছেন। তাদের দেখাদেখি অনেকেই এখন এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। এতে করে এ ইউনিয়নে পড়ে থাকা জমি ও জলাশয়গুলো এখন সবজিতে ভরে গেছে।
তারা বলেন, কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। পরে বিভিন্ন লতা জাতীয় জলজ গাছ সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে স্তর সাজিয়ে এ বেডগুলো তৈরি করা হয়। বেডগুলো ২-৩ ফুট পুরু করে ১০-১২ দিনের মধ্যেই ভাসমান ধাপ বা বেড তৈরি হয়ে যায়। এ ছাড়াও অনেকে এ বেড তৈরি করতে বাঁশ, নারিকেলের খোসার গুঁড়া, তুষও ব্যবহার করে থাকে। এগুলো তৈরি করতে একটি নৌকা বা কলাগাছ দিয়ে তৈরি ভেলা কিংবা তালের ডোঙ্গার (নৌকা) প্রয়োজন হয়। সবকিছু হয়ে গেলে বীজতলা তৈরি করে যে যার পছন্দমতো ভাসমান বাগান তৈরি করেন।
ঝিনাইদহ কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা এডুকেশনের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলাম ছয় বছর আগে প্রথমে বিলে ভাসমান সবজি চাষ শুরু করেন। সে সময় তিনি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি যখন সদর উপজেলার কৃষি অফিসার ছিলাম, তখন এই প্রকল্প চালু করা হয়। প্রথমে চংশোলাকিয়া এলাকার চারজন কৃষক ভাসমান সবজির উৎপাদনে উৎসাহিত হন। তারা প্রথম বছরই কৃষি বিভাগ পুরস্কৃত হন। দিনে দিনে এ পদ্ধতির প্রসার ঘটছে। ওই এলাকার কৃষকদের সাফল্যে আমি আনন্দিত।
মহিনন্দ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম জেবুন্নেছা বলেন, ভাসমান সবজি প্রদর্শনী সাত মাসের প্রকল্প। বর্তমানে তিন মাস চলছে। এরই মধ্যে আশাতীত ফল পাওয়া যাচ্ছে। জমির শাকসবজি অতিবর্ষণ, বর্ষা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভাসমান বেডের শাকসবজির কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে জমির শাকসবজির যখন আকাল দেখা দেয়, তখন ভাসমান বেড থেকে বাজারে শাকসবজির জোগান পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে শাকসবজি আবাদ করে কৃষকরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাসমান পদ্ধতিতে অধিক ফলন ও সবজির বাজারদর ভালো থাকায় অল্প খরচে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। জেলাজুড়ে দিনে দিনে এ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।