প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:০৯ পিএম
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৩৫ পিএম
ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ঘর হারিয়ে নিঃস্ব মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী হনুফা আক্তার। প্রবা ফটো
‘রাতে হঠাৎ করে ঢলের পানি এসে প্রবলবেগে ঘরে ঢোকে। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিতে পারিনি। এক সপ্তাহ ধরে অন্যের বাড়িতে আছি। শুকনো খাবার খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।’ বললেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার ভল্লবপুর গ্রামের স্বামীহারা আনোয়ারা খাতুন। এক ছেলেকে নিয়ে একটি ঘরে থাকতেন তিনি। পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে নেতাই নদীতে ভেসে গেছে তার একমাত্র অবলম্বন সেই ঘরটি। ঘরবাড়ি ভাঙার পাশাপাশি তাদের ফসলের মাঠ এখন ধু-ধু বালুচর।
একই গ্রামের মাহতাব উদ্দিন, রব্বানী, জামাল উদ্দিনদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ ও একটি ফলের বাগান। প্রতি বছর বন্যার পানিতে নেতাইয়ের বুকে চলে যায় ফসলের জমি। এভাবে তাদের দুই একর জমি গিলে খেয়েছে নেতাই নদী। হনুফা আক্তার জানান, জীবনে এমন বন্যা দেখি নাই, পানি যখন আসতে শুরু করছে তখন কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। ভয়াবহ এই বন্যায় উপজেলার নেতাই পাড়ের এলাকাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মোতালেব এবং ময়না আক্তার জানান, বন্যার পানির সঙ্গে তাদের জমিতে বালু এসে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এই বালু সরিয়ে ধান ফলানো যায় কি না তা অনিশ্চিত। পাহাড়ি ঢলে নেতাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে নেতাই পাড়ের মানুষজন নিঃস্ব হয়ে গেছে। দক্ষিণমাইজপাড়া, গামারীতলা এবং ঘোষগাঁও ইউনিয়নে প্রায় অর্ধশত মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। তারা এখন নিঃস্ব হয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিবেদক এই খবর পাঠিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন মাঝে মাঝে এসে নামমাত্র বাঁধ নির্মাণ করেন, পানির এক ধাক্কায় তা ভেঙে যায়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, বন্যার পানিতে অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙেছে এ বিষয়ে অবগত আছি, কয়েকজন এসে আমার কাছে আবেদনও করেছে, আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি, সরকারিভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।
বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল বলেন, বন্যার পানি নেমে গেলে আমরা পরিদর্শন করে সংস্কারের ব্যবস্থা করব। ধোবাউড়ায় বাঁধ রয়েছে ১৫ কিলোমিটার। আমাদের বাজেট অপ্রতুল, বাজেট অনুযায়ী কাজ করা হবে।
নেত্রকোণায় আমনে ৩১৩ কোটি টাকার ক্ষতি
নেত্রকোণা প্রতিবেদক জানান, গত দুদিন ধরে উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় নেত্রকোণায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে পানি কমলেও কাটছে না পানিবন্দি হাজারো মানুষের নানা রকম সংকট। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। এ বন্যার পানিতে তলিয়ে জেলার ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি হিসাবে যার আনুমানিক মূল্য ৩১৩ কোটি টাকা। গতকাল দুপুরে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, নেত্রকোণার ১০টি উপজেলায় এ বছর ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়। এর মধ্যে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর আমন ক্ষেত ও ১৭৭ হেক্টর জমির শাকসবজি।
এদিকে বন্যার পানি কমতে শুরু করায় যারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরছেন, তাদের অনেকেরই ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত। ঘরের ধান-চাল পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খাবারের জন্যও নিম্ন আয়ের এসব মানুষকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট। জেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ রাস্তাঘাট এখনও পানির নিচে থাকায় কাজের সন্ধানে সহজে বের হতে পারছেন না লোকজন।
জেলার দুর্গাপুর উপজেলার কাকৈরগড়া ইউনিয়নের রামবাড়ি গ্রামের জবর আলী বলেন, বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ঋণ করে আমন ধান চাষ করছিলাম। সব ধান পানির নিচে। এখন কী করে সে ঋণ পরিশোধ করব, বুঝতাছি না। বাড়িঘরেও পানি। ঘরে থাকার মতো ব্যবস্থা না থাকায় কয়েকদিন ধরে আত্মীয়ের বাড়ি আছি। পানি কমতে শুরু করলেও ঘরবাড়ি আবার নতুন করে মেরামত করতে হবে।
দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) প্রতিবেদক গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের শাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস আলীর বরাতে জানান, পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে মধ্যরাতে এই গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস আলীর ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। পেশায় ইদ্রিস একজন দিনমজুর। হাতে টাকাপয়সা না থাকায় খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ঘর নেই, খাবার নেই। আশপাশের বাড়িঘর থেকে প্রতিবেলা খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন প্রতিবেশীরা।
ইদ্রিস আলীর প্রতিবেশী আবুল খায়ের বলেন, বর্তমানে ছেলেমেয়ে নিয়ে ইদ্রিস ভাই খুব কষ্টে আছেন। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। কেউ তাকে কোনো সাহায্য করেনি। ঢল তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে।