সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৪৭ পিএম
কিশোরগঞ্জ হাওরের প্রবেশদ্বার করিমগঞ্জের চামড়াঘাট নৌ-বন্দরে পর্যটক ও ভ্রমণকারী না থাকায় নৌকাগুলো যাত্রীবিহীন অবস্থায় বসে আছে। মাঝিমাল্লারা অলস সময় পার করছেন। প্রবা ফটো
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে এবার কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা অনেকটা পর্যটকশূন্য। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাওরে পর্যটক পরিবহনে থাকা বিভিন্ন নৌকার মাঝিমাল্লা, শ্রমিকসহ ব্যবসায়ীরা। পর্যটক টানতে প্রচার-প্রচারণাসহ সুযোগ-সুবিধার প্রচার-প্রচারণার দাবি তাদের।
হাওরের বাসিন্দারা জানায়, বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি বিশেষ ছুটির সুযোগে হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ছুটে গেছে। কিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেনি পর্যটক বা ভ্রমণপিপাসুরা। স্থানীয়রা এটাকে পর্যটক আকাল হিসেবে দেখছে। অথচ শরতের হাওর এক বিস্ময়কর সৌন্দর্যের মোহনীয়তা নিয়ে আসে। সেই সৌন্দর্য দেখতে এ সময় প্রতি বছর শত শত মানুষ হাওরে ভিড় করে। পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য গত ১০ বছরে হাওরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে একাধিক আবাসিক হোটেল। খাবারের জন্য রয়েছে দেশি-বিদেশি মানের খাদ্য সরবরাহের অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ। তারা সবাই এখন বসে বসে লোকসান গুনছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এবার হাওরে পর্যটক এসেছে সংখ্যাগত দিক দিয়ে খুবই কম। ফলে হাওরের ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি ও মাল্লারা বেকার সময় কাটাচ্ছে। অনেকেই অভাব-অনটনে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছে। অর্ধ-শতাধিক ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারীদের মাসিক বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মালিকপক্ষ। তারা আশা করেছিল, এবারের একাধিক সরকারি ছুটির দিনে শত শত লোক ও ভ্রমণকারীদের সমাগম ঘটবে ইটনা, নিকলী, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওরে। কিন্তু তাদের আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। অনেকেই ফাস্টফুডের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাওরের দ্বার হিসেবে পরিচিত চামড়াঘাট নৌ-বন্দর, বালিখলা ঘাট ও নিকলী বেড়িবাঁধে কয়েকশ ইঞ্জিনচালিত নৌকা অলস সময় পার করছে। হাওরের নিকলী, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের পর্যটককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শতাধিক হোটেল রেস্তোরাঁয় ক্রেতা নেই। দুপুর বিকাল কিংবা রাতের খাবার খেতে লোকজনের সমাগম ঘটে না। প্রায় দিনেই চুলায় আগুন জ্বলে না। অলস সময় পার করছেন হোটেলের মালিকসহ কর্মচারীরা।
আলী ইমাম, মো. আলাউদ্দিনসহ একাধিক হোটেল মালিক জানান, অবস্থা খুবই খারাপ। হঠাৎ করে পর্যটকদের সংখ্যা ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। সামান্য পরিমাণ রান্না করা খাবারও অবিক্রিত থাকছে। এমন অবস্থায় পর্যটনের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে।
একটি রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আলী কামাল বলেন, রিসোর্টের অধিকাংশ কক্ষ খালি পড়ে থাকে। গত দুই মাস ধরেই এমন অবস্থা। হাওরে নানা পেশার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে আর্থিক সমস্যায় আছেন। এ অবস্থায় হাওরে আসার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচারণা চালাতে হবে।
মিঠামইন হাওরের একটি রিসোর্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানান, এবার রিসোর্টে ভিড় নেই। অথচ গত বছর এই সময়ে আমরা বুকিং ফেরত দিয়েছি। এবার পর্যটক না আসায় কক্ষ খালি পড়ে আছে। পুরো রিসোর্টটি মেনটেইন খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সমাজকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হাওরে আসার পর সংশ্লিষ্টরা নৌকা ভাড়া, নানা যান ও খাবারের দাম পর্যটকদের কাছ থেকে অধিকহারে আদায় করে। বিষয়টি ভ্রমণকারীরা মন থেকে মেনে নিতে পারে না। এসব ঘটনায় হাওরে ভ্রমণকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই দিন দিন তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ইটনা সদরের বাহাদুল হোসেন বলেন, ব্যবসাটা সারা জীবনের জন্য। তাই মানুষকে বিপদে ফেলে বেশি টাকা নেওয়া যাবে না। এমন করলে বা একবার বিশ্বাস হারালে সারা জীবনের জন্য পস্তাতে হবে। এসব নেতিবাচক খবর এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত থেকে যায়।
ইটনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেযারম্যান ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রতন জানান, হাওরে হঠাৎ ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অসাবধানতা ও কিছু শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যু। পাশাপাশি হাওরে সবকিছুর দাম বেশি নেওয়ার প্রবণতা তো রয়েছেই।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য নাসির উদ্দীন ফারুকী বলেন, এ দেশে আন্দোলন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ভ্রমণ, পর্যটন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। চাল, ডাল আটা, ময়দাসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পকেটে টান পড়েছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা হাওর ভ্রমণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। দেশের সমুদ্রসৈকতসহ অন্যান্য এলাকায় ছুটে গেছেন। তাদের আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচারণাসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করি।
ইটনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান বলেন, ভরা মৌসুমে পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, অতিরিক্ত নৌকা ও অটো ভাড়াসহ খাবারের দাম বেশি ইত্যাদির কারণে হাওরের পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।