হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৫৪ পিএম
আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:০০ পিএম
গত ১৫ বছরে আওয়ামী
লীগের শাসনামলে টাঙ্গাইলে দলটির ২৩ নেতা আগ্নেয়াস্ত্রের ২৭টি লাইসেন্স পেয়েছেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত
এসব নেতার অনেকের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা রয়েছে। তার পরও রাজনৈতিক
প্রভাব খাটিয়ে তারা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়,
লাইসেন্স পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়রাও।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী
লীগ সরকারের পতন হয়। এর পর সরকার গত ১৫ বছর যেসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছে তা
স্থগিত করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু টাঙ্গাইল-২
(গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম
সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান ছোট মনির এবং তার ভাই আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া বড়
মনির তাদের চারটি অস্ত্র জমা দেননি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ইস্যুকৃত এসব অস্ত্রের লাইসেন্স
স্থগিত নয়, বাতিলের দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের
প্রতিনিধিরা।
এদিকে সরকার পতনের
পর এসব নেতাও আত্মগোপনে চলে গেছেন। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের
১৮ জুলাই তৎকালীন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামিলুর
রহমান মিরন শটগানের লাইসেন্স পান। মিরন তখনও আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রহমান খান বাপ্পী
হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। মামলাটি টাঙ্গাইল প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে
সাক্ষীগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়াও মিরনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রায় ৪০টি ফৌজদারি
মামলা হয়েছে।
২০১৪ সালের ২৭
জানুয়ারি টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান
খান রানা পিস্তলের লাইসেন্স পান। তার ২৫ দিন আগে শটগানের লাইসেন্স পান রানার ছোট ভাই
পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি। দুই মাস পর মুক্তি ওই বছরের ৭ মার্চ
রিভলবারের লাইসেন্সও পান। তাদের অপর ভাই ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন তিন
মাস পর ৬ জুলাই রিভলবারের লাইসেন্স পান। ওই লাইসেন্স নিয়ে তিনি অত্যাধুনিক উজিগান ক্রয়
করেন। সেটি টাঙ্গাইল সদর থানায় জমা রয়েছে।
তাদের তিন ভাইয়ের
প্রত্যেকেই জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আব্দুর রউফ এবং পৌর কমিশনার রুমি চৌধুরী হত্যা
মামলার আসামি ছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার কিছুদিন আগেই রাজনৈতিক বিবেচনায়
সরকার তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এই দুই হত্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। এ ছাড়াও রানার
বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একাধিক হত্যাসহ ৪৫টি, মুক্তির বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫টি এবং কাকনের
বিরুদ্ধে অন্তত ৫টি মামলা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা
ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামি। টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে
মামলাটির সাক্ষীর পর্যায়ে রয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে
অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগের
মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তানভীর হাসান ছোট মনির। এর আগের মাসে তিনি ৭ নভেম্বর
শটগানের এবং ২৬ নভেম্বর পিস্তলের লাইসেন্স পান। তার ভাই টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের
সাবেক সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া বড় মনি ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই শটগানের এবং ২০১৭ সালের ৪
জুলাই পিস্তলের লাইসেন্স পান। সাবেক সংসদ সদস্য ছোট মনিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অন্তত
১০টি মামলা হয়েছে। তার ভাই বড় মনিরের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে দায়েরকৃত
একটি মামলায় তার কারাদণ্ডও হয়েছিল। তিনি তখন জার্মান প্রবাসী ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার
গঠনের পর ২০১০ সালে বড় মনির সাজা রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেন।
সরকার পতনের পর
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই দুই ভাই তাদের চারটি অস্ত্রের একটিও জমা দেননি। তবে গত ১২
আগস্ট টাঙ্গাইল সদর থানায় তাদের বাবা আব্দুল গফুর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সেখানে
তিনি উল্লেখ করেছেন, ৪ আগস্ট তার বাড়িতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতা হামলা করে। সেসময়
বাড়ির সব জিনিসপত্র লুটপাট হয়। ওই সময় তার দুই ছেলের লাইসেন্সকৃত চারটি অস্ত্রও লুট
হয়ে যায়।
২০১৪ সালের মার্চ
মাসে উপনির্বাচনে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ
সদস্য নির্বাচিত হন অনুপম শাজাহান জয়। ওই বছর ১৭ অক্টোবর জয় রিভলবারের লাইসেন্স পান।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের
মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ছানোয়ার হোসেন। ওই বছর ১০ ডিসেম্বর তিনি পিস্তলের লাইসেন্স
পান। পরের বছর ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল তিনি শটগানের লাইসেন্সও পান। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর)
আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ও তৎকালীন মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একাব্বর হোসেন
২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর ছোট অস্ত্রের লাইসেন্স পান। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ছোট অস্ত্রের
লাইসেন্স পান টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর- দেলদুয়ার) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল
বাতেন। তারা দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
২০১৭ সালের ৩
মে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী পিস্তলের
লাইসেন্স পান। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের সংসদ সদস্য একাব্বর হোসেন ২০২১ সালের ১৬
নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় উপনির্বাচন।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা যুবলীগের তৎকালীন
সহসভাপতি খান আহমেদ শুভ। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি
শটগানের এবং ২০১৮ সালের ২২ জুলাই পিস্তলের লাইসেন্স পান। শুভ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি
ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুকের ছেলে।
এ ছাড়াও ১৫ বছর
আওযামী লীগের শাসনামলে বেশ কয়েকজন দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর ও ইউপি
চেয়ারম্যান অস্ত্রের লাইসেন্স পান। তাদের মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ আগস্টে গোপালপুর উপজেলা
পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু, ২০১৬ সালের ৫ এপ্রিলে সখীপুর
উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত সিকদার, ২০১৯ সালের
৩১ জানুয়ারিতে ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম পিস্তলের লাইসেন্স
পান।
২০১৭ সালের ২৩
মার্চ টাঙ্গাইল সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের তৎকালীন
সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন মানিক শটগানের লাইসেন্স পান। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই টাঙ্গাইল
পৌরসভার তৎকালীন মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিরন শটগানের লাইসেন্স
পান। ২০১৫ সালের ৭ মে ভূঞাপুর পৌরসভার তৎকালীন মেয়র এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি
মাসুদুল হক মাসুদের নামে পিস্তলের লাইসেন্স ইস্যু হয়। ২০১৬ সালের ১৫ জুন টাঙ্গাইল পৌরসভার
তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল পিস্তলের
লাইসেন্স পান। এই লাইসেন্সে তিনি উজিগান ক্রয় করেন। এর আগে ২০০০ সালে তিনি শটগানের
লাইসেন্স নেন। ২০১২ সালের মে মাসে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কাকুয়া
ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান ফারুক শটগানের লাইসেন্স নেন।
নেতাদের স্বজনরাও
পেয়েছেন অস্ত্রের লাইসেন্স
শুধু রাজনৈতিক
নেতা বা জনপ্রতিনিধি নন, তাদের স্বজনরাও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। ২০১১ সালের
২৩ জুলাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য
মির্জা তোফাজ্জল হোসন মুকুলের ছেলে মির্জা খালিদ হোসেন পিস্তলের লাইসেন্স পান। তিনি
সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমানের শ্যালক। ২০১৯ সালের ২৩ জুন সাবেক
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের মামাতো ভাই খন্দকার তারেকুল ইসলাম এবং ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট
মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার
আলম খান আবুর জামাতা নুরুল আলম খান রাসেল পিস্তলের লাইসেন্স পান। এ ছাড়াও ২০১৩ সালের
১৩ নভেম্বর মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি পরিমল গোস্বামী পিস্তলের লাইসেন্স
পান। তবে অস্ত্র কেনার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের সমন্বয়ক ও জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নবাব
আলী বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বৈরাচার মনোভাব, স্বৈরাচার সরকারের আদেশ ও নির্দেশে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আমাদের ওপর তারা সরাসরি গুলি করেছে। আমরা চাই অতিদ্রুত
সময়ের মধ্যে এই সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে যেন আগ্নেয়াস্ত্রেগুলো উদ্ধার করে লাইসেন্স বাতিল
করা হয়। তাদের আইনের আওতায় আনা হয়।
সুশাসনের জন্য
নাগরিক (সুজন) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তরুণ ইউসুফ বলেন, চিহ্নিত অপরাধীরা কোনো অবস্থায়ই
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারেন না। তদন্ত করে তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে
বাতিল করা প্রয়োজন।
পুলিশ সুপার সাইফুল
ইসলাম সানতু জানান, আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নির্দেশনা ও ফৌজদারি কার্যবিধি
অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।