আমানত উল্যাহ, কমলনগর (লক্ষ্মীপুর)
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৫০ এএম
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শেখ ফরিদ। কিন্তু বর্তমানে লোকে তাকে বলে ফরিদ ডাকাত। রামগতির দুর্গম বয়ারচরের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকাত খোকনের সেকেন্ড ইন কমান্ডার হিসেবে কাজ করতেন। পরে নিজেই একটি বাহিনী গড়ে নাম রাখেন ফরিদ বাহিনী। ওই বাহিনীর লিডার হিসেবে আছেন শেখ ফরিদ ওরফে ফরিদ ডাকাত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রামগতির চরগাজী ইউনিয়নের বয়ারচরে তাণ্ডব চালায় ফরিদের বাহিনী। এখন ফরিদ খোকনের মতো আরেক আতঙ্ক।
নোয়াখালীর হাতিয়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর পালিত ডাকাত ‘ফরিদ’ বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে বয়ারচরে গত দুই মাসে মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ, অপহরণ, মাছঘাট দখল, ডাকাতি, লুটপাট প্রভৃতি অপরাধ করছেন।
সম্প্রতি ফরিদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বয়ারচরের টুমচর এলাকার জহির উদ্দীন রামগতি থানা ও সেনাক্যাম্পে পৃথক দুটি অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ করেন, সরকার পতনের পর ফরিদের লোকজন তার বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঘর ভাঙচুর করে। এ সময় ঘরে থাকা তিন ভরি স্বর্ণ ও চারটি অস্ট্রেলিয়ান গরু নিয়ে যায়। আর তাকে এলোপাতাড়ি কোপায়। বর্তমানে বাড়িঘর ছেড়ে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র রয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সুযোগে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে ব্রিজঘাট, তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকায় হামলা, ভাঙচুর ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, জমি দখল, বসতবাড়ি ও দুটি পুলিশ ফাঁড়ি দখল করেছে ফরিদ বাহিনী।
স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট রাতেই দুই শতাধিক অস্ত্রধারী ডাকাতকে হাতিয়া থেকে রামগতির বয়ারচরের তেগাছিয়া এলাকায় নিয়ে আসেন ফরিদ কমান্ডার। তার ডাকাত বাহিনীতে আছেÑ বাদশাহ, ভুট্টু, ফজলু, আলমগীর, হোসেন, আওলাদ, আইয়ুব আলী, কবির ও মাকছুদসহ অর্ধশতাধিক সদস্য। এসব ডাকাত সদস্য ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রামগতির বয়ারচরের ব্রিজঘাট, তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে।
ফরিদ বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বয়ারচরের দুই শতাধিক পরিবারের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে ফরিদ ও তার বাহিনী।
এর মধ্যে টাংকিরঘাট এলাকায় তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চর জিয়াউদ্দিন গ্রামের শাহাদাতের বাড়িতে ঢুকে স্বামীকে গাছে বেঁধে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। এ ছাড়া সুজন মেম্বারের বাড়ির বাবলু ও রিপনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে ফরিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
সেন্টাল বাজার এলাকার নুরনবী জানান, তাকে বেঁধে ব্যাপক মারধর করা হয়। নগদ ১ লাখ টাকা ও একটি মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। বর্তমান তিনিসহ প্রায় ৩০ জন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
অপহরণ করে একেকজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেছে ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা। এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা ২০ জন। এর মধ্যে বয়ারচরের গিয়াস উদ্দিন জানান, তার কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করলে তিনি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। আরেকজন ভুক্তভোগী সৈয়দ ব্যাপারি জানান, তার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে ফরিদ বাহিনী।
জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত ১৫টি বসতবাড়ি। এর মধ্যে টাংকিরঘাটের বাবলু জানান, তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ফরিদ বাহিনী।
লুট করা হয়েছে তেগাছিয়া, ব্রিজঘাট ও টাংকিরঘাটের অর্ধশতাধিক দোকান। টাংকিরঘাটের সুজন মেম্বার জানান, তার দোকানের প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে তার বসতবাড়িতে আগুন লাগিয়ে বাড়ির মালামাল নিয়ে গেছে তারা। লুট করা দোকানগুলো এখন ফরিদ বাহিনীর আড্ডার ক্লাব।
৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যরা সরে যাওয়ার পর দুটি ফাঁড়িতে ডাকাতদের রান্নার কাজ চলে। এসব অরাজকতার প্রধান হোতা ফরিদ বাহিনীর প্রধান ফরিদ ডাকাত।
ডাকাত ফরিদের নির্মমতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। ২০০১ সালে একটি চর দখলকে কেন্দ্র করে ফরিদের ভাই সোলইমান কমান্ডার, ডাকাত জাহাঙ্গীর বাহিনীর মধ্যে তেগাছিয়া বাজারে গোলাগুলিতে জাহাঙ্গীর বাহিনীর ১৫ জন নিহত হয়। ফরিদের ৮ ভাইয়ের মধ্যে ৫ ভাই আনসারের ট্রেনিং নিয়ে চাকরি না করে এলাকায় করেন ডাকাতি। তারা সবাই ফরিদের সেকেন্ড ইন কমান্ডার। এ ছাড়া ওই বছরে ওই এলাকায় প্রতিপক্ষের ১৬ জনকে একসঙ্গে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে ফরিদ বাহিনী।
২০১৬ সালে তেগাছিয়া এলাকায় অভিযান চালাতে গেলে র্যাব সদস্যদের মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে হামলা চালায় ফরিদ বাহিনী। সে হামলায় চারজন র্যাব সদস্যকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এসব হত্যার ঘটনা ছাড়াও ফরিদ ডাকাত ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে রামগতি, হাতিয়া ও চরজব্বর থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ বেশ কয়েকবার আটক হয়েছেন ফরিদ ও তার বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী এমপির লবিং ও তদবিরে বারবার ছাড়া পেয়ে শুরু করে আবারও তাণ্ডব। ২০১৫ থেকে এ পর্যন্ত টাংকিরঘাট, তেগাছিয়া ও ব্রিজঘাট এলাকা থেকে ৪৮১টি গরু ফরিদ বাহিনী চুরি করেছে বলে একটি সূত্র জানায়।
ফরিদ বাহিনীর অত্যাচার ঠেকাতে রামগতির তেগাছিয়া ও টাংকিরঘাট এলাকায় দুটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। এতে তাণ্ডব কিছুটা কমলেও গত ৫ আগস্ট থেকে আবার শুরু হয়। খোলস পাল্টে ফরিদ রাতারাতি বিএনপির নেতা পরিচয়ে শুরু করেন নারকীয় বর্বরতা।
ওইসব এলাকার দোকানপাট, মাছের আড়ত, বসতবাড়ি ও জমি দখল করে কামিয়েছে ২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ফরিদ কমান্ডারের অন্যতম সহযোগী আলমগীর ব্যাপারীর নেতৃত্বে ৪০০ মাঝির কাছ থেকে বিএনপির নেতাদের নামে তোলা হচ্ছে ৩০০ টাকা করে চাঁদা। চাঁদাবাজি থেকে বাদ যায়নি জালটানা দরিদ্র জেলেরাও। প্রত্যেক জেলেকে দিতে হচ্ছে দৈনিক ৫০ টাকা করে চাঁদা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন রামগতি ও হাতিয়ার সিমান্তবর্তী বয়ারচর এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুখ খুলছে না কেউ। গোটা চর এখন ফরিদ ও তার ডাকাত বাহিনীর ভয়ে তটস্থ।
সরেজমিন গিয়ে মিলছে এসব তথ্য। এ অবস্থায় বয়ারচরে দ্রুত যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবি জানান স্থানীয়রা।
চরগাজী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মীর আক্তার হোসেন বাচ্চু বলেন, ফরিদের তাণ্ডবলীলায় গোটা বয়ারচর আতঙ্কিত। সারা বছর সে করল আওয়ামী লীগ। এখন হঠাৎ শুনি বিএনপি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না থাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে ফরিদ শাসন করছে বিশাল এই চর। এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা ফরিদ ও তার বাহিনী করেনি।
রামগতি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জামাল উদ্দীন বলেন, ফরিদ বিএনপির কেউ নয়। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হবে।
এসব অভিযোগে হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী নৌবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে শেখ ফরিদ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি কোনো অপকর্মে জড়িত নই। ৫ তারিখের পর বাচ্চু চেয়ারম্যানরা ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে আমার অফিস ভাঙচুর করেছে। তার অপকর্ম প্রতিহত করছি আমরা। হাতিয়া ও সুবর্ণচরের লোকজন আমাদের বয়ারচরে তাণ্ডব চালাতে এলে আমি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করেছি। এখন তো যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। এই সুযোগে তারা আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দিচ্ছে।
রামগতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দিন বলেন, দুর্গম বয়ারচরে ফরিদ বাহিনী শাসন করে বেপরোয়া তাণ্ডব চালানোর খবর আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। অচিরেই যৌথ বাহিনী বয়ারচরে অভিযান পরিচালনা করবে। আমরা সবকিছু প্রসেস করছি।