হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:০২ পিএম
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:০৩ পিএম
টাঙ্গাইলের মধুপুরের ঐতিহ্য আনারস জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুনিম হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ নম্বর শ্রেণিতে পণ্যটি জিআই-৫২ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। মধুপুরের স্বাদের আনারস জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়ে খুশি চাষিরা ও জেলাবাসী।
জানা যায়, আনারসের রাজধানী খ্যাত মধুপুর গড়াঞ্চল। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আনারস চাষের গোড়াপত্তন ১৯৪২ সালে। মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের লোকজন প্রথমে আনারস চাষ করেন। মেঘালয় থেকে ৭৫০টি চারা এনে চাষ শুরু করেন তারা। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস চাষ হচ্ছে। শত বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে সুস্বাদু এ আনারস।
মধুপুরের জলছত্র বাজারটি আনারসের জন্য বিখ্যাত হাট। প্রতিদিন কোটি টাকার বেচাকেনা হয় এ হাটে। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে আনারস কিনে নিয়ে যান। আকারভেদে ২০ থেকে ৬০ টাকা ধরে প্রতিটি আনারস বিক্রি হয়। আনারস চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগের নানামুখী উদ্যোগে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চাষির সংখ্যা। মধুপুর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ঢাকা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, নাটোর, রাজশাহী, খুলনা, হবিগঞ্জ, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দিনাজপুরসহ সারা দেশে আনারস যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে আনারস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চাষিরা কেউ ভ্যানে করে, কেউবা সাইকেল আবার কেউ ট্রাক ও পিকআপভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছেন। পাইকাররা এসব আনারস কিনে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করছেন। পরে তা ট্রাকভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে অটোরিকশা ও ছোট্ট পিকআপযোগে যার যার গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।
কেরানীগঞ্জ থেকে আনারস কিনতে এসেছেন পাইকার ব্যবসায়ী তালেব মিয়া। তিনি বলেন, মধুপুরের জলছত্র বাজারে আনারসের পাইকারি হাট হয়। সেজন্য আনারস কিনতে এসেছি। এখানকার আনারস সারা দেশেই পরিচিত; খেতেও সুস্বাদু। এখান থেকে ৬০০ পিস আনারস নিয়েছি, ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
চাষি রাসেল মিয়া বলেন, আমি ছয় বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেছি। এতে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বর্তমান যে বাজার আছে, এ রকম থাকলে খরচ বাদ দিয়ে এক-দেড় লাখ টাকা লাভ থাকবে। আমাদের মধুপুরের আনারস জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে আমরা আনন্দিত।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুপুরের কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, মধুপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য আমাদের এই আনারস। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় গর্বিত, আনন্দিত। বিশ্বমানচিত্রে এই আনারসের কল্যাণে মধুপুর উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্মী বলেন, চলতি বছর জেলায় ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টরে চাষ হচ্ছে। গত বছর জেলায় ৭ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৮২ হাজার টন আনারস উৎপাদন হয়।
তিনি আরও বলেন, জায়ান্টকিউ (ক্যালেন্ডার), হানিকুইন (জলডুবি) ও এম-ডি-টু জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। আনারস থেকে উদ্যোক্তাদের জ্যাম, জেলি, জুস ও আচার উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়া হয়। বিদেশেও রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক শরীফা হক বলেন, রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা টাঙ্গাইল। জেলাটি ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ি ও চমচমের পর এবার মধুপুরের আনারস জিআই পণ্য স্বীকৃতি পেল। এতে আমরা আনন্দিত। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জিআই পাওয়ায় এর বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ আরও বিস্তৃত হবে। জিআইয়ের সুফল পেতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হবে। টাঙ্গাইলের আরও কয়েকটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে।