ইউসুফ আহমেদ, লালমোহন (ভোলা)
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৩ পিএম
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৯ পিএম
ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বসতঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রহিমা বিবির কান্না। সম্প্রতি ভোলার লালমোহন উপজেলার টিপকল বাড়ি এলাকা থেকে তোলা
৪৮ বছর বয়সি রহিমা বিবি। স্বামীর মৃত্যুর পর বৃদ্ধা মায়ের
কাছে থাকতে শুরু করেন। তার মা আমিন্নেছার বয়স প্রায় ১০০ বছর হয়েছিল বলে দাবি তার। সেই
মা-ই রহিমার চোখের সামনে ঘরচাপায় মারা যান। মায়ের এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে
পারছেন না। মৃত্যুর দৃশ্য যখন ভেসে ওঠে রহিমার চোখের সামনে, তখনই ডুকরে ডুকরে কান্না
করছেন তিনি। ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের টিপকল বাড়ি সংলগ্ন ঝুপড়ি ঘরে
গত ৮ বছর ধরে বৃদ্ধা মা আমিন্নেছার সঙ্গে বসবাস করছিলেন রহিমা বিবি। সম্প্রতি লালমোহনে
বয়ে যাওয়া আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে ঝুপড়ি ঘরটি ভেঙে চাপা পড়ে মারা যান বৃদ্ধা মা আমিন্নেছা।
রহিমা বিবি জানান, গত ১০ বছর আগে বাবা মারা যান। এরপর মা
একাই ঝুপড়ি ঘরে থাকা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর মূলত স্মৃতি আঁকড়ে থাকতে ওই ঘরে মা
থাকতেন। মায়ের অনেক বয়স হওয়ায় কিছুই করতে পারতেন না। তাই প্রতিবেশীরা যা সহযোগিতা করতেন
তা দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে পরে বেঁচে ছিলেন।
তিনি বলেন, ৮ বছর আগে স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা
যান। এরপর স্বামীর বাড়ি থেকে এসে বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। মায়ের সঙ্গে থেকে
মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। এ ছাড়া প্রতিবেশীরাও কিছু সহযোগিতা করত। আমার এক ছেলে, এক
মেয়ে রয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, সেও ভালো নেই। যার জন্য ছোট নাতনি আমার কাছেই থাকে।
এ ছাড়া ছেলে বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে। সে আমার কোনো খোঁজ নেয়
না। মানুষের সহযোগিতা ও নিজের কাজের বিনিময়ে পাওয়া সামান্য অর্থে চাল-ডাল কিনে কোনোভাবে
দিন পার করছি।
রহিমা বিবি বলেন, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়
শুরু হয়। তখন আমরা ঘরের মধ্যেই ছিলাম। ওই ঝড়ের তাণ্ডবে ঝুপড়ি ঘরটি ভেঙে যাওয়ার শব্দ
শুনে ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে চৌকির নিচে আশ্রয় নিই। মাকেও চৌকির নিচে নামাব, এরই মধ্যে
ঘরটি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে যায়। ওই সময় ঘরের নিচে চাপা পড়েন মা। তখন চিৎকার দিলে প্রতিবেশীরা
এসে মা ও নাতনিসহ আমাকে উদ্ধার করেন। ঘর চাপা পড়ে মা পেট এবং বুকে প্রচণ্ড আঘাত পান।
ওই আঘাতের তীব্র ব্যথায় মা বারবার ডাক্তার আনতে বলেছিলেন। সকালে ডাক্তারের কাছে নেব
বলে আশ্বাস দিই। এরপর রাত কেটে সকাল হয়েছে। শুক্রবার থেকে দিন বদলে হয়েছে শনিবার। সবই
নিয়মমতো পাল্টেছে। তবে মায়ের আর শরীর ভালো হয়নি। গত শনিবার সকাল ৭টার দিকে মায়ের মুখ
দিয়ে রক্ত বের হয়ে চোখের সামনেই করুণভাবে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর প্রতিবেশীদের সহযোগিতায়
দুপুর ২টার দিকে পাশের বাড়িওয়ালাদের পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
রহিমা বিবি জানান, চোখের সামনে মায়ের করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই
মানতে পারছি না। বয়স হয়েছে, আল্লাহ হয়তো এই উছিলায় মাকে নিয়ে গেছেন। তাই মাকে তো আর
পাব না। আমরা যেই ঝুপড়ি ঘরটিতে থাকতাম তা ভেঙে যাওয়ায় রাতের বেলায় অন্যের ঘরে গিয়ে
ঘুমাই। কয়েকটি লাঠি দিয়ে আপাতত টিনের চালাটা দাঁড় করিয়ে দিনের বেলায় সেই ভাঙা
ঘরটিতে এসে চাল-ডাল রান্না করে খেয়ে ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে থাকি। নতুন করে ঘরটি তোলার
আমার কোনো সাধ্য নেই।
প্রতিবেশী সামছুউদ্দিন সরদার বলেন, বৃদ্ধা আমিন্নেছা এবং
তার মেয়ে খুবই অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন পার করতেন। এখন ঝড়ে ঘরচাপায় বৃদ্ধা আমিন্নেছা
মারা গেছেন। তবে ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ঘরটি তার মেয়ে রহিমার পক্ষে নতুনভাবে তোলার কোনো পথ
নেই। প্রতিবেশী হিসেবে সমাজের বিত্তবানদের এবং সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে অসহায়
রহিমার ঘরটি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে এই উপজেলায় কেউ মারা গেছেন এমন কোনো তথ্য জানা নেই। ঝড়ে ঘরচাপায় কারও মৃত্যু হলে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে আবেদন করলে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদানের চেষ্টা করব।