চট্টগ্রামের বারইপাড়া
সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৫ এএম
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৫১ এএম
দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় কচুরিপানায় ভরে গেছে চট্টগ্রাম নগরীর বারইপাড়া খাল। প্রবা ফটো
২০১৪ সালে বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটির ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। চট্টগ্রাম মহানগরীর হাইজ্জারপুল থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার এই খাল খনন প্রকল্পটির ১০ বছরে তিন দফায় ব্যয় বেড়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকায় ঠেকেছে। তবু আলোর মুখ দেখেনি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। রিটেইনিং ওয়াল, ব্রিজ, ওয়াকওয়েসহ বাকি কাজও শিগগির শেষ হবে বলে দাবি করেছেন প্রকল্প পরিচালক।
বারইপাড়া খালটি চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট মোড় থেকে নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজের পাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। খালের দুই পাড়ে হাজারো বসতি। খাল খননে বিলম্ব হওয়ায় নগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, চকবাজার ও বাকলিয়াসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন স্থানীয়রা।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৪ জুন একনেক সভায় বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পটির অনুমোদন পায়। শুরুতেই ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। পরবর্তীকালে প্রথম দফায় ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় দফায় আবারও প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা করা হয়। তখন মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল গত জুন পর্যন্ত।
সোমবার ( ২৪ সেপ্টেম্বর) বিকালে নগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, বারইপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালটি অপরিষ্কার এবং ময়লা আবর্জনায় ভরা। বহদ্দারহাট মোড়, বাদুরতলা এলাকার পার্শ্ববর্তী বয়ে যাওয়া বারইপাড়া খাল পাড় হয়ে কিছুদূর গেলেই খালে চর জেগে উঠেছে। তবে বারইপাড়া এলাকায় খালের দুই পাড়ে রিটেইনিং ওয়াল দেওয়া হয়েছে। আর দুই পাড়ে সড়ক নির্মাণের জন্য প্রশস্ত জায়গা রাখা হয়েছে। তবে খালটি ভরাট হয়ে পানির ওপর শ্যাওলা জমে থাকতে দেখা গেছে।
বাদুরতলা এলাকার মোহাম্মদ রনি নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, অনেক আগে বারইপাড়া খাল খননকাজ শুরু হয়েছিল। ছয় থেকে সাত বছর আগে আমাদের এলাকার পার্শ্ববর্তী খালের অংশে খনন করা হয়েছিল। এখন তো আবার ভরাট হয়ে গেছে। খালও ময়লা আবর্জনায় ভরা। এই কারণে বৃষ্টি হলেই এলাকায় পানি উঠে মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে ঠেকে। দ্রুত সময়ের মধ্যে খালটির খননকাজ শেষ করলে লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।
বর্তমান প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বারইপাড়া খাল খনন প্রকলের প্রায় দুই কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ। নগরীর এক কিলোমিটার অংশ থেকে বারইপাড়া খালের চাক্তাই অংশ পর্যন্ত ৯০০ মিটার অংশের কাজ বাকি আছে। খালের দুই পাড়ে দুই কিলোমিটার অংশের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ৯টি ব্রিজের মধ্যে ছয়টির কাজ শেষ। বাকি তিন ব্রিজের কাজও চলমান রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ২৫ একরের মধ্যে ইতোমধ্যে ২১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের বাকি কাজও শিগগিরই শেষ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মহানগরীর বহদ্দারহাট, শুলকবহর, নাসিরাবাদ, বারইপাড়া, বাদুরতলা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও চাক্তাই এলাকার অন্তত দশ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে।’
১ হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা অর্থ ছাড় করা হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বরাদ্দের বাকি টাকাও শিগগিরই পাওয়া যাবে।’
প্রকল্পের ডিপিপি সূত্রে জানা যায়, ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বারইপাড়া খালের প্রস্থ ৬৫ ফুট। প্রকল্পের আওতায় খালের দুই পাড়ে ২০ ফুট করে দুটি রাস্তা এবং ছয় ফুট প্রস্থের দুটি করে ওয়াকওয়ে নির্মিত হবে। এ ছাড়া খালের দুই পাড়ে সাড়ে ৫ হাজার মিটার রিটেইনিং ওয়াল, নয়টি আরসিসি ব্রিজ, ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮১ ঘন মিটার মাটি উত্তোলন এবং সাড়ে ৫ হাজার মিটার ড্রেন নির্মাণ ধরা হয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘জবাবদিহি আর স্বচ্ছতা না থাকায় তিন বছরের প্রকল্প দশ বছরেরও শেষ হয়নি। যত বেশি সময় ও ব্যয় বাড়ানো যায় ততদিন বেশি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারী হয়। একটি প্রকল্পে ৫-১০ শতাংশ ব্যয়বৃদ্ধি মোটামুটি মানা যায়। কিন্তু চার থেকে পাঁচগুণ ব্যয়বৃদ্ধি কোনোভাবেই মানা যায় না। এসব লুটপাট করার জন্য বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। মূলত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে এখনও অনেকে প্রভু হয়ে বসে আছে। তাদের মনেই থাকে না যে, তারা প্রজাতন্ত্রের টাকায় মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য বসেছে। সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে অনেকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে। তাই বিদেশি ঋণ নিয়ে করা প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করেছে। ইতোমধ্যে চেয়ার বদল হলেও লুটপাট কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। এসবের লাগাম টানা দরকার।’