রুবেল আহমেদ, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৮ এএম
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:১৫ এএম
মো. তাকজিল খলিফা কাজল। ছবি: সংগৃহীত
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্স থাকলেও বাস্তবে বন্দরে তার কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তবুও তিনি ছিলেন এখানকার কর্তা। তার সিন্ডিকেট ছাড়া এ বন্দরে ব্যবসা করার অধিকার ছিল না কোনো ব্যবসায়ীর। দল-প্রশাসন সবই চলত তার কথায়। খলিফা সাম্রাজ্যের এলাকা হিসেবে পরিচিত ছোট্ট শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা। নানা অভিযোগ-আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এই সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আখাউড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. তাকজিল খলিফা কাজল। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন আখাউড়ার কান্ডারি।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি হাসিবুল হাসান বলেন, সিন্ডিকেটের কবলে বন্দরের ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। সবাইকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। তাকজিল খলিফা কাজলের বিরুদ্ধে থাকলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়তে হতো। তাকে ম্যানেজ করা ছাড়া জনপ্রতিনিধি হওয়ার উপায় ছিল না কারও। বিগত দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ইউপি সদস্য পর্যন্ত নির্বাচিত হয় তাকে ম্যানেজ করে।
জেলা যুবলীগের সহসম্পাদক সৈয়দ মহসিন বলেন, তাকজিল খলিফা কাজলের হুমকি-ধমকি আর মানসিক নির্যাতনে গত ২০১৫ সাল থেকে আমি এলাকাছাড়া। আমি ১৬ সালে পৌর নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হতে চেয়ে ছিলাম। যখন থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছি তখন থেকে আমার পেছনে লেগেছে। আমার অপরাধ, আমি আখাউড়া-কসবা আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট শাহ্ আলম সাহেবকে সমর্থন করতাম।
মেয়রের যত সম্পদ
সাধারণত মামলা থাকলে জায়গা বিক্রি করা যায় না। কিন্তু মামলা থাকাবস্থায় রাধানগর এলাকার একটি জায়গা কিনে নেন তিনি। এরপরই মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন ওই জায়গার কিছু অংশের দাবিদার এক হিন্দু সম্প্রদায়কে।
বছরের পর বছর ধরে একটি জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করে রেখেছেন অ্যাডভোকেট মো. ইয়াছীন খান। রেলওয়ের উচ্ছেদে ওই মার্কেটটি ভাঙা পড়ে। রেলওয়ে জায়গাটি নিজেদের দাবি করে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। এ নিয়ে মামলাও চলমান। এরই মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসেন তাকজিল খলিফা কাজল। জায়গাটিতে একটি স্কুলের সাইনবোর্ড বসিয়ে দেন। তবে শুধু ওই জায়গাটিই নয়, পাশেই রেলওয়ের আরেকটি জায়গাতে খুলে বসেন বাবা-মায়ের নামে প্রতিষ্ঠান। যেখানে সপ্তাহে দুদিন গরিবদের খাওয়ানোর নাম করে মানুষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। আরেক জায়গায় পৌরসভার গ্যারেজ। প্রায় ৩০ শতাংশের জায়গাটির মূল্য ছয় থেকে সাত কোটি টাকা বলে ধারণা করা হয়।
ভেজাল সম্পদে কাজলের নজরÑ এমন কথা যেন মানুষের মুখে মুখে। গত চার বছরে তার ও তার ভাইদের নামে অন্তত ২০টি জায়গার দলিল হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত বছরের মার্চ নাগাদ হওয়া ১৩টি দলিলের সব ধরনের তথ্য এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
এসব তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায়, আখাউড়ার কোথায় খুব বেশি জায়গা কিংবা বিশেষ প্রয়োজনের কোনো জায়গা বিক্রি করতে গেলে তাকজিল খলিফার কাছে ধরনা দিতে হয়। ওনাকে না বলে কেউ বিক্রি করতে গেছেন কিংবা বিক্রি করে দিয়েছেন জানলেই শুরু হয় নানা ধরনের চাপ।
তাকজিল খলিফা সম্প্রতি রাধানগরের একটি ‘ভেজাল’ সম্পত্তিতে নজর দেন। তিনিসহ আরও তিনজন মিলে প্রায় ৩০ শতকের ওই জায়গাটি কিনতে তিন কোটি টাকার চুক্তি করেন। প্রায় নয় মাস আগে চুক্তি হলেও তিনি জায়গাটি কিনছিলেন না। বরং জায়গায় ভেজালের কথা উল্লেখ করে এখন আরও ৬০ লাখ টাকা কম দেবেন বলে জানিয়ে দেন। ওই জায়গাটির কিছু অংশ নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক পরিবারের সঙ্গে বিক্রেতাদের মোকাদ্দমা চলছে। আওয়ামী লীগ নেতা তাকজিল খলিফা কাজল ওই পরিবারের এক সদস্যকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার বিপরীতে কিছু টাকা দেবেন বলে জানান। তবে ওই যুবক টাকার পাশাপাশি জায়গাও দাবি করেন। এতে রাজি হননি তাকজিল খলিফা।
মেয়র কাজলের সর্বশেষ বলি রাধানগরের একটি জায়গা। প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ওই সম্পত্তিতে তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন স্পোর্টিং ক্লাবের সাইনবোর্ড টানিয়ে ঘর তোলেন। ৫ আগস্ট সবার আগে এ ক্লাবঘরটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
২০২০ সালে মেয়র একটি জমি কিনেছেন। এটি হচ্ছে পৌর এলাকার রাধানগরে। ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর মো. শাহীন উদ্দিনের কাছ থেকে সাফ কবলা দলিলমূলে তিনি ২০.৪১ শতাংশ বাড়ির জায়গা কেনেন। আলোচনা আছে জায়গাটির মূল্য ২ কোটি টাকারও বেশি।
২০২১ সালে মোট ছয়টি দলিল হয় মেয়রের নামে। এর মধ্যে নিজের ভাইদের কাছ থেকে কেনা তিনটি দলিল রয়েছে। আলোচনা আছে এসব জমি ভাইদের নামে কিনিয়ে পরে নিজের নামে করে নেন। ১৩ ডিসেম্বর তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিচিত তানিয়া আক্তারের নামে ভবানীপুর মৌজার ১৬৬ শতাংশ জমির দলিল করা হয়।
২০২২ সালে মেয়রের নামে দুটি দলিল করার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ জানুয়ারি তারাগন মৌজার জমি ও ১১ এপ্রিল ভবানীপুর মৌজার দলিল করা হয়। ২০২২ এর এপ্রিলের পর থেকে চলতি নভেম্বর পর্যন্তও বেশি কয়েকটি জায়গা কিনেছেন মেয়র। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি জায়গা কেনার পর ওই মালিকের কাছে রেখে আবার বেশি দামে বিক্রি করে দেন। আবার কিছু জমির দলিলও করেছেন।
সম্পদের খোঁজে দুদক
এদিকে তাকজিল খলিফা ও তার স্ত্রী তানিয়া আক্তারের নামে কী কী সম্পত্তি আছে তা জানতে আখাউড়া উপজেলা সাব রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৪ জুলাই দুদকের কুমিল্লার সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ স্বাক্ষরিত ওই পত্রে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ওই দুজনের নামে ২০ বছরের মধ্যে কোনো জমি, দোকান, প্লট, ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় কিংবা চুক্তি হয়েছে কি না সেটির তথ্য ও দলিলাদি পাঠানোর জন্য বলা হয়।
তবে ওই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে আইনমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এসব কাজ করা থেকে সংশ্লিষ্টদেরকে বিরত থাকতে বাধ্য করেন তাকজিল খলিফা। ক্ষমতার পালাবদলের পর দুদকের ওই কার্যক্রমের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে তাকজিল খলিফা কাজলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়ে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিকালের পর থেকে আর অ্যাক্টিভ দেখায় না। গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের দিন থেকেই তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।
তাকজিল খলিফা ১৯৯৭ সালে আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শাহ্ আলমকে আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে লাঞ্ছিত করে আলোচনায় আসেন তাকজিল খলিফা কাজল। সর্বশেষ ২০২২ সালের মার্চে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন তিনি।