নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:২২ পিএম
শাহে আলম। ফাইল ফটো
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহে আলম। এর পরই নানা অভিযোগে সমালোচিত হতে শুরু করেন তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে যেকোনো কাজে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জনতার হাতে মারধরের শিকার হয়ে গুলশান থানা পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর গুলশান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান হত্যা মামলায় তাকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এমন খবরে স্বস্তি বানারীপাড়াজুড়ে।
আওয়ামী লীগ বনাম শাহে আলম লীগ
২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. গোলাম ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাওলাদ হোসেন সানা দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নসহ ১৭ অভিযোগ এনে শাহে আলমকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠান। সেখানে অভিযোগের মধ্যে রয়েছেÑ উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণে ৫৬ লাখ টাকা হস্তগত করে রাখা, নিজস্ব বলয় তৈরি করে পৃথকভাবে শোক দিবসের কর্মসূচি পালন, চাচাতো ভাই নুরুল হুদাকে বিদ্রোহী প্রার্থী করে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা, নিজ বাহিনী দিয়ে যুবলীগ নেতা আতিক বাপ্পীকে হাতুড়িপেটা, অনুসারী দিয়ে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ফাইয়াজুল হককে গালাগাল ও ভয়ভীতি দেখানো, দলীয় কার্যালয়ের চাবি কুক্ষিগত করে কার্যালয় দীর্ঘদিন অচল করে রাখা, এমপির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উপজেলা মডেল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু না হওয়া, বালিকা বিদ্যালয়ের নামে শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার জমি দখল, উন্নয়নকাজে ৫ ভাগ হারে কমিশন আদায়, সরকারি খাল দখল করে নিজের বাড়ির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, আত্মীয়স্বজনের নামে ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দ এবং বিভিন্ন উৎসব পালনের নামে চাঁদাবাজি।
আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করেন, শাহে আলমের অশোভন ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে অনেক নেতাকর্মী বিব্রতবোধ করতেন। এমনকি তার কারণে দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সবাই মিলে ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দলীয় কার্যালয়ে বৈঠক করে তাকে শোকজ করা হয়। এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় একাধিক আওয়ামী লীগের নেতার কাছেও অভিযোগ দেয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
শাহে আলম এমপি হওয়ার পর উপজেলা নির্বাচনে নিজের চাচাতো ভাই নুরুল হুদাকে প্রভাব খাটিয়ে বানান বানারীপাড়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। তৎকালীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শরীফ উদ্দিন কিসলুকে পরাজিত করে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এমনটা করেন শাহে আলম। এমনকি আরেক চাচাতো ভাই মামুনুর রশিদ স্বপনকে বানান জেলা পরিষদের সদস্য। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটিতে বসাতে থাকেন নিজস্ব লোক ও আত্মীয়স্বজনদের। অভিযোগ আছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় না করে আত্মীয় রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি।
হাতুড়ি বাহিনী
সম্প্রতি হাতুড়ি বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পি জানান, নুরুল হুদার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল হাতুড়ি বাহিনী। শাহে আলমের বিপক্ষে কেউ গেলেই হাতুড়ি দিয়ে মারধর করত বাহিনীটি। নুরুর নেতৃত্বে এই বাহিনীতে ছিল মশিউর রহমান সুমন, সুমন সিদ্দিকি, সজল চৌধুরী, সুমন রায়, রোথেন, রাসেল মাল, মহসিন রেজা, উৎপল শাখারি, তপু খান, দুলাল, মিরাজ, রাহাত মাল, মাসুম বিল্লাহ, উজ্জল তালুকদার, প্রান্ত কুণ্ডু, নাসির, জুনায়েদ ইয়াছিন, তপু তালুকদার। শুধু বিএনপিকেই দমন-নিপীড়ন নয়, এই বাহিনী দমন করেছিল আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীদের।
সম্প্রতি হাতুড়ি বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পি মামলা করেছেন। চাঁদার দাবিতে হামলা, মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শাহে আলমের সঙ্গে তার তিন ভাইসহ ১৪ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
জমি দখল, বাড়ি নির্মাণে দুর্নীতি, কমিশন আদায়
সংসদ সদস্য হওয়ার এক বছরের মধ্যে ভাঙা টিনের ঘর থেকে বানান আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে দখল করেন সরকারি খাল ও স্কুলের নামে বরাদ্দকৃত খাসজমি। অভিযোগ আছে বাড়ি বানাতে গিয়ে বানারীপাড়ার স্থানীয় রড সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাকিতে রড সিমেন্ট নিয়েও তার টাকা পরিশোধ করেননি তিনি।
আলিশান বাড়ির পাশাপাশি হিন্দুদের জমি দখলেও বেশ জোর দিয়েছিলেন তিনি। সর্বপ্রথম বিতর্কের জন্ম দেন ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর; সড়ক সংস্কার ও প্রশস্তকরণের কারণ দেখিয়ে ভেঙে ফেলেন বিপ্লবী কুমুদ বিহারী গুহঠাকুরতার সমাধির সীমানা দেয়াল ও স্মৃতিস্তম্ভের আংশিকাংশ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হলে দ্রুত সমাধিটি সংস্কারের ব্যবস্থা করেন শাহে আলম।
এরপর ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার পারিবারিক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে শাহে আলমের নামে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসককে লিখিত অভিযোগ দেন অনুপ কুমার গুহ। ঐ মাসের ২৫ তারিখ বরিশাল প্রেস ক্লাবে বানারীপাড়ার পশ্চিম তেতলা গ্রামে ১২ পরিবারের জমি দখল চেষ্টার অভিযোগে শাহে আলমের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন কৃষক রতন ঘরামী। এরপর জিম্মি করে জমি লিখে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ এনে আদালতে একটি নালিশি অভিযোগও করেন তিনি। এ ঘটনা তদন্ত করে সত্যতা পায় বাংলাদেশ হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানান বাংলাদেশ হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত। এমনকি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, এসবের পাশাপাশি যেকোনো সরকারি কাজে তাকে দিতে হতো ৫ পার্সেন্ট কমিশন, যা আদায় করতেন বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শুভ্রত কুণ্ড ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খোরশেদ আলম সেলিম।
হতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা
সংসদ সদস্য হয়ে শাহে আলম হতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তবে তার বাবা ডা. সায়েদ উদ্দিন তালুকদারের নামে বানারীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নানা অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লেখা বানারীপাড়া উপজেলার বেইজ কমান্ডার বেনী লাল দাস গুপ্তসহ ২০ মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর শাহে আলমের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়টি নজরে আসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শাহে আলম যেন স্থান না পায় তার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী ও সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠি দেন তারা।
চিঠিতে আরও লেখা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকায় নাম এসেছিল ডা. সায়েদ উদ্দিন তালুকদারের। যদিও পরে সেই তালিকা বাতিল করে সরকার। সেটা ঢাকতেই মুক্তিযোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন শাহে আলম।
এসব বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও শাহে আলমকে পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি এক টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘যেখানে যা কিছু আছে, সবই আমার ফাইলে আছে।’