দুর্নীতি-অনিয়ম
রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৫৩ পিএম
এনামুল হক। ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হককে গত সোমবার দুপুরের দিকে রাজধানীর আদাবর থেকে আটক করেছে র্যাব। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত অভ্যুত্থানের সময় রাজশাহীর বাগমারায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যাচেষ্টাসহ স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে র্যাব তাকে আটক করেছে। র্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি এনামুল ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তিনি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনামুল হককে ঘিরে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঋণ পরিশোধ না করা, ভূমি দখল, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যসহ প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের মতো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠেছে, হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিও তিনি। এ অবস্থায় তার সম্পদসহ দুর্নীতি-অনিয়মের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দিতে হতো সুনির্দিষ্ট কমিশন
বাগমারার একাধিক ভুক্তভোগী জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে এলাকায় শত শত বিঘা জমি দখলের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে এনামুল হক হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। র্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি দখল, বিভিন্ন পুকুর খনন প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি চাকরি দেওয়া, তাহেরপুর পৌরসভার যেকোনো বরাদ্দ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাকে সুনির্দিষ্ট কমিশন দিতে হতো। বাগমারা উপজেলার যেকোনো বরাদ্দকৃত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাজেট থেকেও ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো তাকে।
দখল করেছেন চার ফসলি ২০ বিঘা জমি
বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তৎকালীন এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ও তার ভাই মাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল হক লেদা প্রকৃত জমির মালিকদের মামলার ভয় দেখিয়ে হামলা চালিয়ে এসব বহুমূল্যবান চার ফসলি জমি হাতিয়ে নেন। জমির মালিকদের মূল্যও পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি জমিতে থাকা ফসল তুলতে গেলেও তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
এখানে বেদখল হওয়া প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির মালিক আশিক আলী পরামাণিক বলেন, এনামুল যখন জমি দখল করতে শুরু করল, আমরা সবাই তখন মামলা করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জমির দলিলে দেখানো হয়েছে ডোবা! এখন পর্যন্ত কোনো টাকা দেয়নি। উল্টো বলেছে, আমরা নাকি জমি দান করে দিয়েছি। পুলিশ, ইউএনও, এসি ল্যান্ড সবাই তার কথায় উঠত-বসত।
ওই প্রকল্পের জমির পাশে দাঁড়িয়ে যখন আশিক আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তার মতো আরও ১৫ জন ভুক্তভোগীও কথা বলেন। তারা সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।
ভবানীগঞ্জ বাজার এলাকার সত্তরোর্ধ্ব সামায়ন আলীর দাবি, তার কোটি টাকা মূল্যের জমিও এমপি এনামুল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালিয়ে দখলে নিয়েছেন। সম্প্রতি সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছেন ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক। সামায়ন আলী বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেকের জমি দখল করে নিয়েছেন এমপি ও তার পছন্দের মেয়র মালেক। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়ে লাভ হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসন সবাই ওর লোক।’
শক্তি প্রয়োগ করে গড়ে তুলেছেন ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট
এলাকাবাসীর দাবি, এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক এমপি এনামুল। কেউ প্রতিবাদ করলেই হেলমেট বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হতো। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা হতো। এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তিনি ভবানীগঞ্জে নিজের একটি বহুতল মার্কেট গড়েছেন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ভবানীগঞ্জ নিউমার্কেট। এই মার্কেট নির্মাণের আগেও সেখানে একাধিক দোকান ছিল। সেগুলো প্রভাব খাটিয়ে ভেঙেচুরে ফেলেছেন।
ভুক্তভোগী জুলেখা খাতুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের ওখানে দুটি দোকান ছিল। আমাদের দাদার আমলে বানানো সেসব দোকান। দোকান দুটি থেকে ১০টি পরিবারের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু এনামুল নিজের মার্কেট করতে গিয়ে ওইসব দোকান ভেঙে ফেলেছে। তার মার্কেটের সামনের রাস্তা প্রশস্ত করেছে।’
প্রতি শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা!
স্থানীয় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও রেহাই পায়নি এনামুলের দুর্নীতি থেকে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ পরিচালনা কমিটি করে দেওয়ার নামে এনামুল হক হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। আর এই কাজে তার সহযোগী ছিল সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসহ পরিচালনা কমিটি।
ভবানীগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ও একাধিক শিক্ষক জানান, এনামুল এমপি থাকার সময় ভাইস প্রিন্সিপালের মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন। এই এক কলেজ থেকেই প্রায় দেড় কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে তার তত্ত্বাবধানে। শিক্ষকপ্রতি নেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। অনুদানের টাকা এলেও আত্মসাৎ করতেন তিনি। যেহেতু হিসাব মিলছে না, সেহেতু এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেই ধরে নিতে হবে। এমন ঘটনা ঘটেছে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
২০০৮ সালে বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ২০ লাখ!
২০০৮ সালে ইঞ্জিনিয়ার এনামুলের বার্ষিক আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। স্ত্রীর ছিল না কোনো আয়। তবে দুজনের শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। তবে ১৫ বছরের ব্যবধানে এনামুলের বার্ষিক আয় বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর বার্ষিক আয় না থাকলেও দুজনের নামে শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ রয়েছে পৌনে ১৪ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, এনামুল ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন স্ত্রীর নামে। আওয়ামী লীগ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণে পেয়েছেন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র (নর্দান পাওয়ার প্ল্যান্ট)। এমপি থাকার সময়ই এনামুলের বিরুদ্ধে একাধিক নারী কেলেঙ্কালির ঘটনাও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
শ্রমিক বিক্ষোভ চলছে সাবেক এমপির গার্মেন্টসে
রাজশাহী নগরীর বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত সাবেক এমপি এনামুলের গার্মেন্টস সাকোয়াটেক্স লিমিটেডে বেতন না পেয়ে কষ্টের মধ্যে রয়েছেন শ্রমিকরা। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কয়েক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় শ্রমিকরা রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘি মোড় এলাকায় সিটি সেন্টারের সামনে রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান নেন। ফলে একপাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, একসময় এ কারখানায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু এখন করছেন মাত্র ৩৫০ জনের মতো। তাদের কারও সাত মাসের, কারও তিন মাসের, কারও দুই মাসের বেতন বাকি। বিদ্যুৎ বিল শোধ না করায় কয়েক মাস আগে কারখানার সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।