রাজশাহী জুড়ে নৈরাজ্য
রাজশাহী অফিস
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:৫৮ এএম
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:০০ এএম
ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী জুড়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজ চক্র। এই চক্রটি ট্রাক, বাস টার্মিনাল, ফুটপাতসহ সিএনজি স্ট্যান্ডগুলোতে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। লুট করে নিয়ে যাচ্ছে পুকুর ও দিঘিতে চাষ করা লাখ লাখ টাকার মাছ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হাতবদল হয়েছে চাঁদাবাজি ও দখলদারদের নেতৃত্ব। আর সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিএনপি নেতাদের নাম। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। পুলিশ বলছে, শিগগির তারা নিজেদের মধ্যকার জড়তা কাটিয়ে মাঠে নামবেন।
রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকা জিরোপয়েন্ট। এখানে অবস্থিত টাইম ওয়াচ নামের একটি ঘড়ির দোকানে চাঁদার ২০ হাজার টাকা না পেয়ে মালিকের ছেলে সঞ্চয়কে সম্প্রতি পিটিয়ে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যায় কয়েকজন সন্ত্রাসী। ৫০ গজ এলাকার মধ্যে বড় মসজিদের পাশে ভাজাপোড়া বিক্রি করেন রুহুল। তার কাছে প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে চাঁদা দাবি করে আসছে অপর একটি গ্রুপ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট এলাকার ফুটপাতে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা। তার হয়ে ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে আসছিল অমিত, নিপুণ, নাহিদ, সঞ্জয়। তবে পটপরিবর্তনের পর এই চক্রটি গা ঢাকা দিয়েছে। এখন নতুন করে একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এদিকে গত ৯ আগস্ট রাজশাহী নগরীর সিরোইলে অবস্থিত বাস মালিক সমিতির কার্যালয় দখলকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং বাস মালিক ও শ্রমিকদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মামুন অর রশীদ ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদার সমর্থকরা। এ ঘটনায় উভয়পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যানকে লাঞ্ছিত এবং তার ক্যামেরা ভাঙচুর করে হামলাকারীরা।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাস মালিক সমিতির কার্যালয় দখলে নেয় মিজানুর রহমান মিনুপন্থি যুবনেতা রাকেশ চৌধুরী গৌতম। তবে বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একাংশ। এরই জেরে ৯ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে সাবেক কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান শরিফের নেতৃত্বে তিন শতাধিক নেতাকর্মী হামলা চালায় বাস মালিক সমিতির কার্যালয়ে। তারা বাস মালিক ও শ্রমিকদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক পেটায়। এতে সমিতির আহ্বায়ক রাকেশ চৌধুরী গৌতমসহ ১৫ জন আহত হয়।
এদিকে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ১৭ আগস্ট সকালে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। ওই সংবাদ সম্মেলনে মিনু দাবি করেন, বিএনপির ওই নেতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ জানানো হয়েছে। বিএনপির কেউ চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করতে এলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে জানাতে হবে।
একই চিত্র উপজেলাগুলোতে। হাট ও ঘাট, পুকুর ও লিজকৃত জমিগুলো একটি চক্র দললে নিয়েছে। সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর বাগমারা উপজেলার গাঙ্গোপাড়া জনতা ব্যাংকের সামনে থেকে আফজাল হোসেন নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর ৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় তাকে পিটিয়ে জখম করা হয়। জমা দেওয়ার জন্য তিনি টাকা নিয়ে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন। একই দিনে তাহেরপুর পৌরসভা এলাকায় পৃথক স্থানে চারজনকে পিটিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা।
আহতদের মধ্যে তাহেরপুর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র বাবুল খান রয়েছেন। গত সোমবার দুপুরে পৌরসভা ভবন থেকে বের হয়ে মথুরাপুর এলে তার ওপর হামলা হয়। এ সময় তাকে পিটিয়ে টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। পরে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসব ঘটনায় থানায় একাধিক অভিযোগও করা হয়েছে।
বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের গাঙ্গোপাড়া এলাকায় রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাসিবুল আলমের ৯০ বিঘার পুকুর দখল ও প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়েছে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। হাসিবুল আলম জানান, মাড়িয়া ইউনিয়নের গাঙ্গোপাড়া এলাকার সন্ত্রাসী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একই এলাকার ফেরদৌস রহমান, জাহিদ হাসান, মুনজুর রহমান, বাবু, লিটন ও আশরাফুল ইসলাম ব্যবসায়ী হাসিবুল আলমের কাছে চাঁদা দাবি করে। তিনি চাঁদা দিতে রাজি না হলে ৯০ বিঘার তিনটি পুকুর দখল ও মাছ লুট করে বিক্রি করে দেয়।
ব্যবসায়ী হাসিবুল আলম আরও জানান, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল ৫ বছর মেয়াদে তিনটি পুকুর লিজ নেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে ফজলুসহ এলাকার ২০-২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ পাহারাদারকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়ে পুকুরগুলো দখলে নেয়। এ সময় তারা পুকুরের মাছ লুটপাট করে। এতে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুটপাট হয়েছে বলে ব্যবসায়ী হাসিবুল আলম জানান।
এছাড়াও গত ১৭ আগস্ট তাহেরপুর পৌরসভার জামগ্রাম এলাকার চারটি পুকুরে বিষ দিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুট করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। একইভাবে বাগমারা উপজেলার ২৫-৩০টি পুকুর দখল ও প্রায় শতকোটি টাকার মাছ লুট করা হয়েছে গত এক মাসে।
জেলা পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান জানান, ৫ আগস্টের পর পুলিশ কিছুটা অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছিল। তবে সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আর কাউকে দখল, লুটপাট ও ছিনতাই করতে দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশ বিতর্কিত হয়ে পড়ে। দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। রেঞ্জসহ এসপি ও কমিশনার পরিবর্তন করা হয়েছে। আরও কিছু রদবদল হবে। কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ পুরোদমে কাজ শুরু করবে।