বেনাপোল স্থলবন্দর
তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:৫৩ পিএম
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের রপ্তানি টার্মিনালে রাখা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি। বৃহস্পতিবার তোলা।
দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল। প্রতিদিন ভারত থেকে পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বন্দরের আমদানি টার্মিনালে প্রবেশ করে। অনুরূপভাবে কয়েক শতাধিক রপ্তানিবাহী ট্রাক পণ্য নিয়ে রপ্তানি টার্মিনাল হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে বন্দরের রপ্তানি টার্মিনালের জায়গা দখল করে গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যারেজ তৈরি করেছে বলে অভিযোগ। চুক্তিপত্রের আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে ম্যানেজ করেই এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে বন্দরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য নিয়ে ট্রাকগুলো রাস্তার দুই ধারে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যানজট সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বন্দর টার্মিনাল চার্জ বাবদ সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন দেশে থেকে কয়েক শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক রপ্তানি টার্মিনালে অবস্থান করার কথা। কিন্তু টার্মিনালটিতে গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবে গ্যারেজ ও গ্যারেজের মেরামতের বিভিন্ন ধরনের উপকরণ রাখায় টার্মিনালটি রপ্তানিকারকরা ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে যশোর-বেনাপোল সড়কের দুইপাশে রপ্তানি ট্রাকগুলো দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এ কারণে রাস্তায় অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। যানজটের কারণে ভারতগামী যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। যানজট এতটাই প্রকট হয় যে, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি সেবা প্রদানকারী বাহনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্দরের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বন্দরের উপপরিচালক রেজাউল করিম ও তার অনুসারীরা বিশেষভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে রপ্তানি টার্মিনালে গ্যারেজ নির্মাণের অনুমতি দেন। তাই কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে দেখেও না দেখার ভান করছে। তা ছাড়া বন্দরটিতে প্রতিমাসে ক্রেন-ফরক্লিপের মাধ্যমে ১০০ থেকে ১৫০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য লোড-আনলোড কাজ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী বন্দরের মালামাল লোড-আনলোড করার জন্য গ্রেট বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজের ১১টি ফরক্লিপ ও ৬টি ক্রেন থাকার কথা। কিন্তু কাগজে-কলমে রয়েছে সাতটি ক্রেন ও নয়টি ফরক্লিফ। তার মধ্যে বর্তমানে দুটি ক্রেন ও তিনটি ফরক্লিপ সচল রয়েছে। বাকি সব নষ্ট হয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। যেগুলো সচল রয়েছে সেগুলোও নির্ধারিত ওজনের লোড-আনলোড করতে পারে না বলে অভিযোগ।
রপ্তানিকারক কামাল এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম রবি বলেন, রপ্তানিযোগ্য প্রতিটি ট্রাক থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৮০ টাকা করে আদায় করে। অথচ টার্মিনালে কখনও রপ্তানিপণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করতে পারে না। টার্মিনালটি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে পুরাতন নষ্ট ক্রেন ও ফরক্লিপসহ তাদের গ্যারেজ ও স্টোর টার্মিনাল তৈরি করেছে। ফলে রপ্তানিযোগ্য পণ্যবাহী ট্রাকগুলো টার্মিনালে প্রবেশ করতে না পেরে ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় রাস্তার দুই পাশে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এতে ওই এলাকায় অসহনীয় যানজট হয়। যে কারণে ভারতে যাতায়াতকারী পাসপোর্ট যাত্রীরা চরম দুর্ভেগের শিকার হয়। এমনকি জরুরি সেবার যানবাহনগুলোও যানজটে আটকে থাকতে হয়। বিষয়টি নিয়ে বন্দর পরিচালককে বারবার জানিয়েও কোনো সুফল মেলেনি।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিক আশরাফুল আলম বলেন, রপ্তানিকারকরা সাধারণত পাট ও পাটজাত উৎপাদিত পণ্য ও মাছ ভারতে রপ্তানি করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে টার্মিনালটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি দখল করে রাখায় রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক রাখা সম্ভব নয়। এ কারণে পণ্যের একদিকে যেমন নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটছে, অন্যদিকে রাস্তার ধারে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো দীর্ঘ সময় থাকাতে যানজট সৃষ্টি হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি টার্মিনাল ছেড়ে দিয়ে তাদের নিজস্ব জায়গায় গ্যারেজ তৈরি করলে রপ্তানিকারকরা মালামাল নির্বিঘ্নে ভারতে পাঠাতে পারবে। আর যানজটে যাত্রীসাধারণও নাকাল হতো না।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেতে টার্মিনালে গেলে গ্রেট বেঙ্গলের ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কৌশলে চলে যান। পরে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের সব বন্দরের জায়গা গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। বেনাপোল বন্দরেও সেভাবে কাজ করছি। এই পর্যন্ত বন্দরের কেউ আমাদের বাধা সৃষ্টি করেনি।’ বন্দরে মালামাল লোড-আনলোডের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বিকলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান সানি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বেনাপোল বন্দরের শুরু থেকেই নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। একদিকে যেমন অনৈতিকভাবে বন্দরের রপ্তানি টার্মিনাল ব্যবহার করে সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে; অন্যদিকে তাদের ব্যবহার করা অধিকাংশ ক্রেন ফরক্লিপ বছরের বেশিরভাগ সময়ই অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। বন্দরের মালামাল লোড-আনলোড করতে খুবই অসুবিধা হয়। দিনের পর দিন মালামাল বন্দরে পড়ে থাকে। এতে আমদানিকারকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের জায়গা দখল করাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। বাইরে এ পরিমাণ জায়গা নিয়ে একটা গ্যারেজ তৈরি করতে হলে প্রতি মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকা ভাড়া গুনতে হতো।
বন্দরের পরিচালক রেজাউল করিমকে চলতি মাসের ১ তারিখে বেনাপোল থেকে বদলি করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। পরে খুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে বন্দরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক রাশেদুল নাজির বলেন, ‘চুক্তিপত্রে বন্দরের জায়গা ব্যবহার অথবা না ব্যবহারের কোনো বিষয়ই উল্লেখ নেই।’ তাই তিনি এসব বিষয় না লিখে প্রয়োজনে তাদের অধিকাংশ ইকুইপমেন্টের কার্যক্ষমতা নেই ও নষ্টের বিষয়টি নিয়ে লেখার পরামর্শ দেন তিনি।