পাহাড়ের ঐতিহ্য
অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই (রাঙামাটি)
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:১৮ পিএম
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:১৯ পিএম
কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ইউনিয়নের চাকুয়াপাড়ার একটি মাচাং ঘর। প্রবা ফটো
অন্যসব অঞ্চলের মতো পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। বহু বছর ধরে তারা এসব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন করে আসছে। পাহাড়ে বাস করা মারমা সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী ঘর রয়েছে। নান্দনিক এসব ঘর সাধারণত মাচাং ঘর নামেই পরিচিত। ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে এসব ঘর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তিন পার্বত্য জেলার শহর এলাকাতে এসব ঘর ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। তবে পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে এখনও মাচাং ঘরের দেখা পাওয়া যায়।
মাচাং ঘরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো সাধারণত তৈরি হয় ছন দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল। আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। মাচাং ঘরগুলো দেখলেই মনে হবে শিল্পীর নিপুণ হাতে স্পর্শ রয়েছে সেখানে। দক্ষ হাতে আঁকা নকশার আদলে তৈরি হয়েছে ঘরগুলো।
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করে অনেক পরিবারের বসবাস। এই ঘর পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা ছোট ছোট পাড়াগুলোতে গুচ্ছবদ্ধভাবে দেখা যায় এসব মাচাং ঘর।
মাচাং ঘরের ঐতিহ্য হিসেবে আরও জানা যায়, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো বন্য পশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করত। সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হতো এসব ঘর। মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় পার্বত্যাঞ্চলে ছনের ব্যাপক কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের ফলে ছনের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখন জঙ্গলে বাঁশ-ছনের তেমন দেখা পাওয়া যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া বাঁশের দাম বেশি, সে কারণে এখন মাচাং ঘরের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
মাচাং ঘরে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়নের চাকুয়া পাড়ার বাসিন্দা হ্লালা চিং মারমা, মংসাই মারমাসহ অনেকেই। তারা বলেন, সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হয় মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো গাছের তৈরি। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশেও খুঁটি তৈরি হয়ে থাকে। মাচাংয়ের সঙ্গে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সি কচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘরের তেমন আর দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন।
তবে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নেরর বাসিন্দা সামাপ্রু মারমা, রেমেচিং মারমাসহ অনেকেই বলেন, মাচাং ঘর আমাদের ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে এটি বর্তমানে কমে এলেও এখনও মাচাং ঘরের প্রতি অনেকের ভালোবাসা রয়েছে। তাই অনেকেই এই ঘরে বসবাস করে থাকেন। তবে মাচাং ঘরের একটা সমস্যা হচ্ছে এই ঘর তৈরিতে বর্তমানে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয় কিন্তু ঘরগুলো ২-৩ বছরের বেশি টেকে না। তা ছাড়া বনজঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে গাছ ও বাঁশ। সে কারণে খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘরের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বিভিন্ন সমস্যা হলেও এই মাচাং ঘর আমাদের সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। তাই আমাদের এই মাচাং ঘরের সংস্কৃতি হারাতে দেওয়া যাবে না। এই ঐতিহ্য আমাদের ভবিষ্যতেও টিকিয়ে রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত সরকারের আমলে পাহাড়ের এই মাচাং ঘরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার প্রায় ৪০টি পরিবারকে বিনামূল্যে মাচাং ঘর উপহার দেওয়া হয়েছে। যেই ঘরগুলোতে বর্তমানে পরিবারগুলো বসবাস করছে।