জলাবদ্ধ কক্সবাজার শহর
নুপা আলম, কক্সবাজার
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০৪ পিএম
কক্সবাজারে পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। প্রবা ফটো
কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকা। এতদিন সকলের ধারণা ছিল, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের এই পর্যটন জোনে সচরাচর জলাবদ্ধতা দেখা দেয় না। কিন্তু গত তিন মাসে সেখানে চার দফা জলাবদ্ধতা হওয়ায় মানুষের সেই ধারণায় চিড় ধরেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে ডুবে গেছে কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকার সবগুলো সড়ক, সৈকত-সংলগ্ন ও মার্কেট এলাকা। বৃষ্টিতে আরও ডুবেছে কক্সবাজার শহরের পাঁচ কিলোমিটারের প্রধান সড়ক। বৃষ্টির পানি জমেছে সড়কের বাজারঘাট, বড়বাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদীঘিরপাড় এলাকার দোকান, অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। হাজারো ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে পানির নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভয়ানক জলাবদ্ধতার নেপথ্যে রয়েছে ৫৮৬ কোটি টাকার দুটি সড়ক প্রকল্প।
অস্বাভাবিক উঁচু চার লেনের সড়ক
এমন জলাবদ্ধতা কখনও দেখেননি কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার। তিনি বলেন, ‘ভারী বর্ষণ হলে হোটেল-মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এর জন্য দায়ী চার লেনের সড়ক। সড়কটি নির্মাণ করার সময় সেটিকে আগের চেয়ে অস্বাভাবিক উঁচু করা হয়েছে। অন্যদিকে নালার অংশ ছোট করে ফেলার পাশাপাশি এর ওপরে স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সড়কের পানি নালায় নেমে যাওয়ার পথ রাখা হয়নি। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতেই পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে নালাকে ভরাট করে ফেলেছে। ভরাট নালা পরিষ্কার বা কাটার কোনো সুযোগও রাখা হয়নি। তাই বৃষ্টির পানি দ্রুত সাগর-নদীতে নেমে যেতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।’
এমন জলাবদ্ধতা দেখেননি কক্সবাজার বাঁচা আন্দোলনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আয়াছুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘লাবণীর মোড় থেকে কলাতলী হয়ে লিংক রোড় সড়কের মতো কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কেরও একই অবস্থা। এই সড়ক সংস্কারে সময় গেছে তিন বছরের বেশি। প্রধান সড়কটি আগের চেয়ে কম হলেও ৩ ফুট উঁচু করা হয়েছে। এতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট নিচে নেমে গেছে। পাশের নালা ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। নালা পরিষ্কার করার সুযোগ নেই। সড়ক উঁচু হওয়ায় এর দক্ষিণ এলাকার পানি উত্তরের বাঁকখালী নদীতে যেতে পারছে না। ফলে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানি নালায় নামতে পারছে না। এই জলাবদ্ধতার মাশুল গুনতে হচ্ছে শহরবাসীকে। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকছে। মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে।’
একইভাবে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকাও সড়ককেই দায়ী করলেন কলাতলী ও শহরের জলাবদ্ধতার জন্য। তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিত, অস্বাভাবিক উঁচু, স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা প্রায় ৬ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্প এখন জনগণের ভোগান্তির একমাত্র কারণ।’
‘উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এমন ভোগান্তি’
লাবণী মোড় হয়ে কলাতলী-লিংক রোড় চার লেনের সড়কটি নির্মাণ করেছে কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ। ২০১৯ সালের নভেম্বরে চালু হওয়া সড়কটি ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার সফরে আসা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন। কক্সবাজার শহরের লাবণী পয়েন্ট থেকে লিংক রোড পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করার প্রকল্পটির ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২৮৮ কোটি টাকা।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্যমতে, মাঝখানে ১০ ফুট ডিভাইডার, দুইপাশে ৬ ফুট করে ড্রেনসহ সড়কটি প্রশস্ত হয়েছে মোট ৭১ ফুট। ২৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৯০ কোটি জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ জমির মালিকদের দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্থ সড়ক নির্মাণে ব্যয় করা হবে।
কক্সবাজার শহরের হলিডের মোড় থেকে বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কটির সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২৯৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজটি শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। আগের প্রকল্পের সঙ্গে এটিকেও ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন কক্সবাজারে সফরে আসা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মোটেল লাবণী মার্কেটের ব্যবসায়ী সিফাত জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানে গত তিন মাসে চারবার বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে। নালা বন্ধ হওয়ায় পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এমন ভোগান্তি।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট রিদুয়ান আলী বলেন, ‘প্রধান সড়ক সংস্কারের সময় জোর প্রতিবাদ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সড়কটিকে অস্বাভাবিক উঁচু না করতে। কিন্তু কেউ শোনেনি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।’
কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত
কক্সবাজারে গত শুক্রবারের তুলনায় কাল শনিবার বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। এ পরিস্থিতিতে শহরের জলাবদ্ধ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও বেড়েছে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা। এখনও সদরসহ ছয় উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম জলবন্দি।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান বলেন, ‘গত শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২১০ মিলিমিটার। এখনও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে গত শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ৪৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।
বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কক্সবাজার শহরের পরিস্থিতি এখন কিছুটা উন্নতির দিকে। পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকার সকল সড়ক, সৈকত-সংলগ্ন এলাকা, মার্কেট এলাকা থেকে নেমে গেছে পানি। শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদীঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাঁচা মিয়ার ঘোনা ও পাহাড়তলী এলাকা থেকেও পানি নেমে গেছে। তবে শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়াসহ ৮টি নিম্নাঞ্চল এখনও জলবন্দি।