আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেনী
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৫৯ পিএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:১৮ পিএম
হাজেরা বেগম। প্রবা ফটো
সাম্প্রতিক বন্যায় ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা ফুলগাজী। এ উপজেলার মুহুরী নদীর পার্শ্ববর্তী দরবারপুর ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রামে এখন শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। গ্রামের একটি সড়কের ১৭টি স্থানে ভেঙে গেছে। ধসে পড়েছে বহু ঘরবাড়ি, নষ্ট হয়েছে ফসলি জমি। মারা গেছে অসংখ্য গৃহপালিত পশু।
এ গ্রামের বাসিন্দা হাজেরা বেগম। সড়ক ভেঙে পানির স্রোতে ভেসে গেছে তার বসতঘর। বর্তমানে সন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়ি নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন। সরকার ও উচ্চবিত্তদের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন, আর কিছু চাই না, শুধু ঘরটি ঠিক করে দিন।
বন্যাকালীন নিজের দুর্বিষহ স্মৃতি তুলে ধরে হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমার তিন ছেলেমেয়ে। দুটোই শিশু, শাশুড়িও বৃদ্ধ। যখন পানি আসছে আমরা হাহাকার শুরু করি। বাঁচার জন্য পার্শ্ববর্তী একটি ছাদে উঠে যাই। আমি সাঁতার জানি না। এখান থেকে নৌকায় করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই। আমার শাশুড়ি ভেবেছেন আমরা মারা গেছি। এজন্য তিনি পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। জীবন বাঁচাতে পারলেও আর কিছুই বাঁচাতে পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে। এ জীবন রেখে আর কী হবে। আমার বাচ্চাগুলোর কী হবে, কেমনে চলব?’
পানির স্রোতে বিলীন হওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে আহাজারি করছিলেন তিনি। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরি নদীর পানির চাপে সড়ক ভেঙে স্রোতে ভেসে যায় হাজেরার শখের আসবাবপত্র, ভেঙে যায় থাকার ঘরসহ চারটি ঘর। ছাগল, হাঁস, মুরগি সবই চলে গেছে বানের জলে। এখন তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘর ঠিক করার সম্বলটুকুও নেই তার।
কৃষি কাজ করে তিলে তিলে এই সংসার গড়েছেন হাজেরা ও তার স্বামী ওমর ফারুক। তিন সন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়ি মিলে সুখের সংসার ছিল তাদের। বন্যায় বিলীন হয়ে পথে বসেছে হাজেরার পরিবার।
হাজেরা বেগম বলেন, ‘এক নিমিষেই পানি গলা সমান উঠে যায়। আমার তিনটা সন্তান। একটা পাঁচ বছরের শিশু, একটা আট বছরের। মেয়েটার বয়স ১৫ বছর। কেউ সাঁতার জানি না। প্রথমে এসে ঘরের সামনের অংশে লাগে পানির চাপ। আমরা বের হতে হতে পানি কোমরসমান হয়ে যায়। চোখের সামনে সবকিছু চলে গেল। তখন ভেবেছিলাম, এ জীবন রেখে কী করব। জীবন মানেই তো যুদ্ধ। তো পানির সাথে যুদ্ধ করে মরে যাই।’
তিনি বলেন, ‘এখন ঘরে দাঁড়াব সে জায়গাটাও নেই। আমার খাট নেই, চেয়ার নেই, কাঁথা-বালিশ নেই। কীভাবে কাজ করব। আমার ছেলেমেয়েরে কী দেব? ওদের তো বই-খাতা সব ভেসে গেছে। বাচ্চারা মানুষের বাড়িতে আছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, যে সাহায্য করতে পারেন করেন। এখন সাহায্য ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নাই। দয়া করে আমার ঘরটা ঠিক করে দেন। যাতে অন্তত থাকতে পারি।’
হাজেরা বেগমের প্রতিবেশী মর্জিনা আক্তারের ঘরও ভেসে গেছে স্রোতে। সঙ্গে ভেসে গেছে আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। রান্নাঘরও ভেঙে গেছে। থাকার ঘরের অবস্থা নাজুক। সব হারিয়ে নিঃস্ব মর্জিনা বেগম। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মর্জিনার স্বামী নুরুল আমিন। তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মর্জিনাও এখন অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায়।
মর্জিনা বেগম বলেন, ‘চাইল ডাইল ঘর বেগ্গিন ভাসি গেছি হানিতে। যে ক্ষতি হইছে বাই (ভাই) কিচ্ছু নাই অ্যার। ব্যাক কিছু নষ্ট অই গেছে। হাকঘরডাও (রান্নাঘর) টানি নিছে, কিচ্ছু নাই আর। আপনেরা যদি সাহায্য করেন আন্ডা বাঁচি। আপনেরা সাহায্য করেন। আন্ডা খুব অসহায়।’
মর্জিনার মতো জগৎপুর গ্রামে অন্তত ৫০টি পরিবারের প্রায় সবই বিলীন হয়েছে বন্যায়। বন্যার পানি নেমে গেলেও ঘরবাড়ির বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সইতে পারছে না স্থানীয়রা। শোকে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কেউ নির্বাক তাকিয়ে আছে লন্ডভন্ড হওয়া ঘরবাড়ির দিকে। এখন সাহায্য ও পুনর্বাসন ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই পরিবারগুলোর।
জগৎপুর এলাকার শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমার দুটা ছাগল ভেসে গেছে, হাঁস-মুরগি সব গেছে, ২০ মণ ধানও নেই। দক্ষিণের ঘরের শুধু পিলারগুলো আছে। এখন খাব যে তার উপায় নাই। বাজার করব তার টাকা নাই। এখন ভিক্ষুকের মতো বসে আছি সাহায্যের জন্যÑ কে আসবে সাহায্য করবে।’
জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দপ্তরগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই তালিকা করে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এ ছাড়া আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম চলমান আছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এলে পুনর্বাসনের কাজ খুব দ্রুত শুরু হবে।’