সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:২৮ এএম
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:১৯ এএম
জুনায়েদ
‘আমি আর কখনোই নিজের পায়ে ভর করে হাঁটতে পারব না স্যার! সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচতে হবে। একটু দাঁড়াতে চাইলেও অন্যের সাহায্য নিতে হবে, হাঁটতে হবে ক্রাচে ভর করে। দেশের সবকিছু ঠিক হয়ে গেলেও আমি তো পরাধীন হয়ে গেলাম স্যার।’
বলছিলেন আর হুহু করে কাঁদছিলেন ২৫ বছরের জুনায়েদ। তার পাশে বসা চাচা কাশেম মিয়া নিজেও চোখ মুছতে মুছতে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে। ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের দিন পুলিশের গুলি লাগার পর থেমে যেতে চলেছে তার পথচলা। আত্মীয়স্বজনরা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানালেন, ২২ বছর আগে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হতে হয়েছে জুনায়েদের বাবা হাবিবুর রহমানকে। এবার তার সন্তানকেও পঙ্গু হতে হলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে।
জুনায়েদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে প্রথম থেকেই সমর্থন করে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ৫ আগস্ট চারদিকে যখন সবাই আন্দোলনের সাফল্য উদ্যাপনে ব্যস্ত, তখন তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় থাকতে হয় হাসপাতালের বেডে।
গতকাল রবিবার দুপুরে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হয় জুনায়েদের। কথায় কথায় জানা গেল, যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন জুনায়েদ। অভাব-অনটনের সংসারে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন তিনি। জুলাইয়ে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে ঢাকার কর্মসূচিগুলোর সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে ওঠেন জুনায়েদ।
জুনায়েদ বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুরে শাহবাগ থেকে গণভবন ঘেরাও করার কর্মসূচিতে যোগ দিতে মাদ্রাসার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। প্রথমে সাইনবোর্ড এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী গেলাম। এ সময় সেনাবাহিনী ও বিজিবি আমাদের কোনো বাধা দেয়নি। কিন্তু সামনে এগিয়ে কাজলায় পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়। সেখান থেকে দফায় দফায় হামলার পর যাত্রাবাড়ী থানা পর্যন্ত পৌঁছাই। সেখানে দুপুর প্রায় ২টার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় একটি ভ্যানের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নিই। দীর্ঘক্ষণ পালিয়ে থাকার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ আমাদের কাছে চলে আসে। পুলিশের কাছে মাফ চেয়ে পাশের গলি দিয়ে দৌড় দিই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লক্ষ করে গুলি চালায় পুলিশ। আমাকে খুব কাছ থেকে গুলি করেছিল।’
জুনায়েদ জানান, এ সময় পুলিশের গুলিতে তাদের এক বন্ধু নারায়ণগঞ্জের গোলাম রাব্বি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি বলেন, ‘হাঁটুতে গুলি লাগায় আমিও সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাই। গোলাগুলি থামার পর স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীরা আমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন। সেখান থেকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তাররা জানান, পায়ের দুটো রগ ছিঁড়ে গেছে। চিকিৎসকদের পরামর্শে তখন আমার পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও পা রেখে দেওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাননি।’
জুনায়েদের এমন করুণ পরিণতিতে বাকরুদ্ধ তার পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এ অবস্থা পরিবারের কেউই মানতে পারছেন না। তার সহপাঠী মাহবুব আলম বলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রামের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। আশা করি জুনায়েদের সাহায্যে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবেন।’ একই সঙ্গে এ আক্রমণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও জানান তিনি।
প্রতিবেশী খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘জুনায়েদের পরিবার একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে। দেশের জন্য সে আন্দোলন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বিনিময়ে একটি পা হারিয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, জুনায়েদের পরিবারের জন্য এমন কিছু করা হোক, যাতে তার বাকি জীবন সুন্দরভাবে চলতে পারে।’
কিশোরগঞ্জের যুবদল নেতা মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘জুনায়েদের পা হারানোর ঘটনা আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। জুনায়েদ কোনো দলের না। সরকারের কাছে অনুরোধ, জুনায়েদের পরিবারের প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা জীবন মিয়া বলেন, ‘যাদের জন্য জুনায়েদের এ অবস্থা হয়েছে, তাদের বিচার চাই।’
জুনায়েদের বাবা হাবিবুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার একটি মাত্র ছেলে। এ ছেলেই আমার ভরসার জায়গা। খাওয়াদাওয়াসহ পুরো সংসার ওই চালাত। এখন কী হবে, কিছুই জানি না।’
জুনায়েদ বলেন, ‘আমি দেশের জন্য, এ জাতির জন্য যতটুকু সম্ভব করেছি। পা হারিয়েছি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় টিউশনি করতাম সংসার চালানোর জন্য। এখন সরকার আমাদের জন্য কী করবে, জানি না। তবে যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, সেজন্য আমরা সবাই আনন্দিত।’