রাজবাড়ী
মো. শাখাওয়াত হোসেন সোহান, রাজবাড়ী
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১৫ এএম
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:২৬ এএম
রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক এমপি জিল্লুল হাকিম। ছবি : সংগৃহীত
মাত্র ৫০ হাজার টাকা ঋণখেলাপির দায়ে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার অবস্থায় ধার করে নির্বাচন করার পর রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি হয়ে আর পিছনে তাকাতে হয়নি জিল্লুল হাকিমকে। চলতেন সামান্য একটি মোটরসাইকেলে। এখন কোটি টাকা মূল্যোর কয়েকটি গাড়ি রয়েছে। ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। স্ত্রী-সন্তান মিলে দুই হাতে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গড়ে তুলেছেন নামে বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
জমিদখল, এলজিইডি, বিশেষ বরাদ্দ, কাবিখা, স্কুল, কলেজ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদ থেকে অবৈধ বালি উত্তোলন, সাব রেজিস্ট্রি অফিস নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিটি দপ্তর থেকে কমিশন আদায়, ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি, পুলিশে চাকরি, জাপানে লোক পাঠানো, অর্থের বিনিময়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদান ও চাকরি প্রদানসহ এহেন দুর্নীতি নাই যা তিনি করেননিÑ এমন অভিযোগ রয়েছে। সাংসদ নির্বাচিত হয়েই দুশ কোটি টাকায় রেলমন্ত্রীর পদ বাগিয়ে নেন। এমন নানা অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একাধিকবার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে।
জিল্লুল হাকিম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। রাজবাড়ী-২ আসন থেকে জুন ১৯৯৬ সাল, ২০০৮ সাল, ২০১৪ সাল, ২০১৮ সাল, ২০২৪ সালে এমপি হন। টানা ১৫ বছরের শাসনামালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ছিল তটস্থ। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ দাখিল করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। অভিযোগটি ফাইল চাপা পড়ে যায়। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন জিল্লুল হাকিম ও সঙ্গে তার অনুসারীরাও আত্মগোপনে রয়েছে।
শুধু জিল্লুল হাকিমই নন, তার বাড়ির কাজের লোক হিসেবে পরিচিতরাও হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ সদস্য ও কোটি টাকার মালিক। জিল্লুলের অবৈধ টাকা কালেকশনে সিন্ডিকেটে মিজানুর রহমান মজনু, পাংশার গোবিন্দ কুন্ডু ওরফে গম গোবিন্দ, বালিয়াকান্দির এহসানুল হাকিম সাধন, কালুখালীর আলিউজ্জামান চৌধুরী টিটুসহ একটি বড় সিন্ডিকেট। জিল্লুলের ছেলে মিতুল হাকিমের নেতৃত্বে গড়ে তোলে হাতুরিবাহিনী। এ বাহিনীর প্রধান মনোয়ার হোসেন জনি। এদের হাত থেকে রেহাই পায়নি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।
পাংশার নারায়ণপুরের খন্দকার নজরুল ইসলামের ছেলে বিপ্লব খন্দকার বলেন, তাদের বাপ-দাদার ভোগদখলীয় প্রায় শতবর্ষী জমিতে থাকা একটি আধুনিক মানের হোটেল প্রকাশ্যে রেলওয়ের লোকজন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর আগে রেলওয়ের লোকজন ৫ কোটি টাকা দাবি করে। পরে সাবেক রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম প্রকাশ্যে মিটিংয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। আরও ভাঙার ঘোষণা দিলেও রহস্যজনক কারও একটি ঘরও ভাঙেনি।
পাংশা উপজেলা সাবেক যুবলীগ নেতা দিবালোক কুণ্ডু জীবন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও আমাকে হত্যাচেষ্টা করাসহ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমি বিচার দাবি করছি।
পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার দুই হাত, দুই পা ভেঙে ও কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। আমি হামলাকারীদের বিচার দাবি করছি।
কাজী মোমিনুল ইসলাম বলেন, সৈয়দা সিদ্দিকা বেগম দাবি করে জমিটি তার। পরে আদালতের মামলায় বন্দনা রানীরা পেলেও তাদেরকে প্রকাশ্যে উচ্ছেদ করে। আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি।
বন্দনা রানী বলেন, আমাদের জমি দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে দখলে নিয়েছে। শুধু তাই নয় সাবেক রেলপথমন্ত্রীর বাসায় শাশুড়িকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ৩ দিন পর ফেরত দেয়। পরে আবার আমাকে রাত ১২টার সময় গম গোবিন্দের গোডাউনে নিয়ে যায়। সেখানে সাবেক রেলপথমন্ত্রীর চাচাতো ভাই রুমি হাকিমের উপস্থিতিতে হুমকি দেয়। পরে আমাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করাসহ লুটপাট করে। আমরা বিচার দাবি করছি।
কালুখালীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, রাজবাড়ী-২ আসনে দলের অন্তত ৪২ জন নেতা-কর্মী হামলা-মামলা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেকেই তার ভয়ে বাড়ি ছাড়া হতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের নিকট অনুরোধ জানান।
রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক আলহাজ আকবর আলী মর্জি ইতঃপূর্বে সাংবাদিকদের বলেন, ৯৬ সালে যখন জিল্লুল হাকিম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পায়, তখন ৫০ হাজার টাকা ঋণখেলাপির দায়ে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। সেই টাকা হাওলাত নিয়ে মনোনয়ন বৈধ করলেও তা কোনোদিন ফেরতও দেয়নি।