রহিম শুভ, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৪২ পিএম
আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৪২ পিএম
হরিপুরের চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অন্য স্থানে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রবা ফটো
চা বিক্রেতা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদির কথা কমবেশি সবারই জানা। এ ছাড়াও চা বিক্রি করে জীবনে সফলতার চূড়ায় ওঠা অনেক ব্যক্তির গল্প অনেকের জানা আছে। কিন্তু শিক্ষকতা চাকরির লোভে একজন চা বিক্রেতা প্রভাব খাটিয়ে একটি বিদ্যালয় এক স্থান থেকে গায়েব করে অন্য স্থানে স্থাপন করে সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছে এমন ঘটনা বিরল।
বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালে দেশ সেরা হিসেবে পুরুস্কারপ্রাপ্ত ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রধান শিক্ষক হয়ে ওঠার নেপথ্যের ঘটনা। বিদ্যালয়টি সরকার অনুমোদিত জমি থেকে সরিয়ে নিজ জমিতে স্থাপন করার পর একটি ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেন চা বিক্রেতা এরফান আলী। তিনি একা নন, বিদ্যালয়ের সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব ও ভয় দেখিয়ে একই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি দিয়েছেন নিজের স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন ও দুই বোন রেহেনা খাতুন এবং মিতালি পারভিনকে। সেই থেকে একই পরিবারের চারজন শিক্ষক দিয়ে পরিচালনা হয়ে আসছে বিদ্যালয়টি।
সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এমন অভিযোগ তুলে ধরে তদন্ত দাবি করেন স্থানীয় গ্রামবাসী ও গ্রামের ওই স্কুলের সাবেক একাধিক বঞ্চিত শিক্ষক ও শিক্ষকের চাকরিপ্রত্যাশী একাধিক যুবক এবং বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান। এদিকে গ্রামের এক যুবককে শিক্ষকতার চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সাত লাখ টাকা নেন এরফান আলী।
অভিযোগ তুলে ধরে গ্রামের চাকরিপ্রত্যাশী যুবক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ২০১৪ সালে এরফান আলী যখন বিদ্যালয় আগের জায়গা থেকে খুলে নিয়ে নিজের জমিতে প্রতিস্থাপন করেন, তখন আমাকে তাদের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দেন এবং আমার থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। তবে আমাকে তিনি চাকরি দেননি। এখনও পুরো টাকা ফেরতও দেননি তিনি। এই চাকরিপ্রত্যাশী ক্ষতিগ্রস্ত যুবক বলেন, ২০১৪ সালের আগে এরফান আলী কোনো শিক্ষকতা করেননি । তিনি যে ২০০৮ সালে তার চাকরির যোগদান দেখাচ্ছেনÑ এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
গ্রামবাসী জানান, তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রত্যেক ওয়ার্ডে দুটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার ঘোষণা আসে। সে সময় এ ওয়ার্ডে একটিমাত্র সিংহাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। গ্রামের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে ২০০০-২০০১ সালের দিকে আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামবাসী।
এর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হলে কীভাবে বিদ্যালয় চালু করতে হবে সে নিয়ম জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয় আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সব নিয়মকানুন মেনে বিদ্যালয়ের জন্য ৩৩ শতক জমি রেজিস্ট্রি করে দেন গ্রামের দুই ব্যক্তি আ. রহমান ও কদম আলী। এই জমিতে টিনের বেড়া দিয়ে স্থাপন করা হয় চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রামের লোকজন এক সভা আহ্বান করে গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি করে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়। সে সময় শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আলতাফুর রহমান, নাসরিন আক্তার, নুর নাহার, জসিম উদ্দীন।
তাহলে এরফান আলী যে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে সেটি কোনটি?
প্রবীণ গ্রামবাসী জানান, চা বিক্রেতা এরফান আলীর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা থাকলেও তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। গ্রামে ২০০০-২০০১ সালের দিকে বিদ্যালয় হওয়াতে তার এ লোভ অতি লোভে পরিণত হয়েছিল। সে যেন এখানে অসৎ উপায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারে এরজন্য নকল শিক্ষাগত সনদসহ নানা কৌশল অবলম্বন করে। যখন কোনোভাবে পেরে ওঠে না তখন নিজে থেকে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেয় এবং গ্রামবাসী অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রামছাড়া করার পাঁয়তারা করে।
এলাকাবাসীর দাবি, এরপর ২০১৩ সালে দেশের বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ জাতীয়করণ হলে শিক্ষক হওয়ার লোভ মাথাচারা দেয় এরফান আলীর। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন আমলে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাদের মদদে অস্থায়ী বিদ্যালয়-ঘর খুলে দিনদুপুরে গায়েব করে দেন এবং পরে নিজের জমিতে বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেকায়দায় পড়েন। এরপর প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষকও হয়ে যান।
তৎকালীন চরভিটা বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলতাফুর রহমান বলেন, যখন স্কুল ঘরটি ভাঙা হয় তখন আমরা এরফান আলীর ভয়ে ছিলাম। সে সব সময় আমাদের হুমকি ও মামলার ভয় দেখাত। তবে শেষমেশ আমি সাহস করে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেছি। বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ার আগে আমরা যত নথিপত্র তৎকালীন রাজশাহী বোর্ডে প্রেরণ করেছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে নথি গায়েব হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমি উপজেলা প্রশাসনকে অভিযোগপত্র দিয়েছি।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলীর দাবি তিনি কোনো বিদ্যালয় সরাননি। তার দাবি ২০০১ সাল থেকে অদ্যাবধি নিজের স্থাপিত চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করে আসছেন।
কিন্তু কাগজেকলমে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালে ২৭ ডিসেম্বর এরফান আলী চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছেন এবং এই বছরের পহেলা ডিসেম্বরে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যদিও তার শিক্ষাগত সনদপত্র নিয়ে সন্দেহ আছে এলাকাবাসীর। স্থানীয়দের প্রশ্ন ২০০৮ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলে এবং সে বছরে চাকরিতে যোগদান করলে ২০০১ সাল থেকে কোথায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি?
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ে আমি একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্তের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না।