ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০০ এএম
ফাইল ফটো
সঞ্চালন-বিতরণ লাইনে দুর্বলতা এবং নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষত গ্রামাঞ্চল বেশিরভাগ সময়ই থাকছে বিদ্যুৎহীন। কারণ গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে লুটপাটের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল চারটি সিন্ডিকেট। সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নে মুজিববর্ষের নামে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণে ১৫ লাখ গ্রাহকের সংযোগ প্রকল্পের জন্য ট্রান্সফর্মার ক্রয় থেকে এই চক্র হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নসরুল হামিদ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। সাবেক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কারণে জ্বালানি খাতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও বিদ্যুৎ খাতে প্রতিমন্ত্রীর ছিল একচ্ছত্র প্রভাব। বিশ্লেষকরা বলছেন, বারবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং বিপুল লোকসানের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কার্যক্রম ও দায়মুক্তি আইনের আড়ালে দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার পন্থাই দায়ী। ওই সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন মহলের দুর্নীতিও এ খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৪২ শতাংশ, গ্যাসের ১৪০ শতাংশ
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অংশই গেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধেÑ যার পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। গত ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে খুচরা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। বর্তমানে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। গত সাড়ে ১৫ বছরে খুচরায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৪২ শতাংশ। ২০০৯ সালে গ্যাসের দুই চুলার মাসিক বিল ছিল ৪৫০ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা। গত সাড়ে ১৫ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৪০ শতাংশ। এ সময় বিদ্যুৎ খাতের লোকসান ঠেকেছে ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে। বিপরীতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। শতভাগ বিদ্যুতায়নের কথা বলা হলেও পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা রয়েছে এখনও শতভাগ অন্ধকারে। অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুতের এক শ্রেণির কর্মকর্তা জড়িয়ে পড়েছেন শতভাগ দুর্নীতিতে।
এত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল না
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তার একচ্ছত্র প্রভাব ছিল জ্বালানি খাতে। বিশেষ করে, গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়া, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি ও এলপিজি ব্যবসায় সুযোগ বৃদ্ধি, কূপ খননসহ বিভিন্ন কাজে এই উপদেষ্টা প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাকসহ প্রায় দুই ডজন সংসদ সদস্য সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানা প্রকল্পের কাজ পান। সামিট, ইউনাইটেড পাওয়ার, বাংলাক্যাট, মোহাম্মদী গ্রুপ, ডরিন, বারাক, সিনহাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি এ সময় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এত কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল না। কারণ অনেক কেন্দ্র নামমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে আয় করে দেশ থেকে পাচার করেছে।
আখের গুছিয়েছেন আমলারা
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের অংশীদার হয়ে আখের গুছিয়েছেন মূলত একাধিক আমলা। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল নামে বিতর্কিত প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখেছিল সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ, বিদ্যুৎ সচিব আহমেদ কায়কাউস, অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর ও খালিদ মাহমুদ, আইপিপি সেলের বিভিন্ন সময় পদে দায়িত্বে থাকা গোলাম কিবরিয়া, মাসুদ আল বিরুনী ও মাহবুবুর রহমানের হাত ধরে। আবুল কালাম আজাদ ও আহমেদ কায়কাউস পরে মুখ্য সচিব হয়ে বিদ্যুতের অনেক প্রকল্প নয়ছয়ে ভূমিকা রাখেন। এই কর্মকর্তারা সুবিধা নিয়ে অতিরিক্ত দামের বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি করতে ভূমিকা রাখেন। প্রসঙ্গত বিশেষ আইনে প্রকল্পের দরদাম ঠিক করতে যে নেগোসিয়েশন কমিটি থাকে, তার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন বিদ্যুৎ সচিব।
সচিবের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন প্রতিমন্ত্রী
গ্যাস সংকটের কারণে সরকার দীর্ঘদিন গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখলেও বিশেষ বিবেচনায় শিল্পে কিছু সংযোগ দেওয়া হয়। সাবেক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী ছিলেন এ-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের কমিটিপ্রধান। এই কমিটির বিরুদ্ধে গ্যাস সংযোগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জ্বালানির নানা কার্যক্রম নিয়ে সাবেক এই উপদেষ্টার সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, ঢাকা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নসরুল হামিদের মতবিরোধ ছিল ‘ওপেন সিক্রেট।’
স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে বাধা সৃষ্টি করায় নাজিম উদ্দিন চৌধুরীসহ জ্বালানি বিভাগের একাধিক সচিবের সঙ্গে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই সময়ের বিদ্যুৎ সচিব আহমেদ কায়কাউস, যিনি পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হন, তার সঙ্গে নসরুল হামিদের বিরোধ ছিল সচিবালয়ে আলোচিত ঘটনা।
নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এক ভাতিজা ও কেরানীগঞ্জের শাহীন চেয়ারম্যান মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে জোট করে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়। এমনই একটি প্রকল্প হলো ডিপিডিসি, পিডিবি, ডেসকো, আরইবি ও নেসকোর অ্যাডভান্স মিটারিং, মিটার স্থাপন, বিলিং প্রকল্প ও নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি-সংক্রান্ত প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প।
একইভাবে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানি বিদেশি দুটি কোম্পানির সঙ্গে একটি এলপিজি প্রকল্পের কাজ পায়। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ আছে, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী কামরুজ্জামান চৌধুরী সম্পর্কে নসরুল হামিদের মামা।
অভিযোগ- আওয়ামী লীগ নেতাদের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে স্থান দিয়ে প্রতিমন্ত্রী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সিলেটের বিভিন্ন গ্যাসকূপ খননে চীনের সিনোপ্যাককে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন।
সোলারভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনেও অনিয়ম
একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি ধাপে সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হতো। গত দুই বছরে ২৭টি সোলারভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। ১ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াটের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের অধিকাংশই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি। তাদের মধ্যে নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছাড়া শরীয়তপুরের সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাক, বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সাবেক পরিচালক জালাল ইউনুস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছোট ভাই, আবদুস সালাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টাঙ্গাইলের সাবেক এমপি তানভীর হাসান (ছোট মনির), সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুর রহমান, সিলেটের হাবিবুর রহমান এমপি ও রাজশাহী অঞ্চলের এক এমপির প্রত্যেকে একটি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পান।
উল্লেখ্য, সমঝোতার মাধ্যমে দেওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্রয়চুক্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। টেন্ডার না করার ফলে বেশি দামে অধিকাংশ প্রকল্পের চুক্তি হয়েছে। বিশেষ করে, সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে যে অবৈধ লেনদেন ঘটে, তার অধিকাংশ হয়েছে বিদেশে।