চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৪ এএম
মীর গ্রুপের মালিকানাধীন একটি ওয়্যারহাউস থেকে বিলাসবহুল দামি গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। ছবি : ভিডিও থেকে নেওয়া
বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের সম্পদ রক্ষায় যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম বিএনপির কিছু নেতা। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন জমি ও সম্পদ কেউ যেন না কেনেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এই ঘোষণার পরপরই বৃহস্পতিবার রাতে দেখা যায় নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকার একটি ওয়্যারহাউস থেকে একে একে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এস আলম পরিবারের ব্যবহৃত ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। যার মধ্যে রয়েছে- বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ও অডি, পোরশে ও রেঞ্জরোভার ইত্যাদি। গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে চট্টগ্রামের কয়েকজন বিএনপি নেতাকে।
পর্যবেক্ষণে আরও দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকেই এস আলমের সম্পদ রক্ষায় বিএনপির ওই নেতারা সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মইজ্জ্যারটেক এলাকায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কিছু কারখানায় আগুন লাগানোর চেষ্টা করে একদল দুর্বৃত্ত।
জানা গেছে, তখন এস আলমের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চেয়ে ফোন করা হয় কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়াকে। ফোন পেয়ে মামুন মিয়া নেতাকর্মীদের নিয়ে দ্রুত এস আলমের কারখানার সামনে পৌঁছেন। সে সময় কারখানা ভাঙচুর করতে আসা দুর্বৃত্তদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মামুন মিয়া নিশ্চিত হন, তারা বিএনপি বা ছাত্রদলের কেউ নন। শেষে তিনি তাদের তাড়িয়ে দেন। ফলে কারখানাগুলো লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পায়।
দ্বিতীয় দফায় গত ২৯ আগস্ট দুপুরে পটিয়া উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নে এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমের গ্রামে নির্মাণাধীন এস আলম হাউস থেকে নির্মাণসামগ্রী লুটের চেষ্টা চলে। ওই সময় স্থানীয়রা লুটের ঘটনা ঠেকিয়ে দেয়। নির্মাণাধীন ভবনের মালামাল রক্ষায়ও বিএনপি নেতারা সহযোগিতা করেছেন বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে ঘটেছে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা। এ কাজে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতারা সরাসরি সহযোগিতা করেছেন বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক এনামুল হক এনাম, কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের গাড়িচালকসহ বেশ কিছু বিএনপি নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শুরুতে মইজ্জ্যারটেক এলাকার গুদাম থেকে গাড়িগুলো সরানোর তথ্য প্রচারিত হলেও পরে জানা গেছে, এগুলো কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার একটি গুদাম থেকে সরানো হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বেয়াই সম্পর্কের আত্মীয় এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা গাড়ি সরিয়ে দিতে যাইনি। প্রকৃতপক্ষে মীর গ্রুপের মালিক মীর আবদুস সালাম ফোনে আমাদের জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠান থেকে বিএনপি পরিচয়ে ১০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়ে ফোন করা হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদা দাবি করার বিষয়টি জেনে তা প্রতিহত করতেই গিয়েছিলাম। কারণ দলীয় নির্দেশনা আছে, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যেন বিএনপির নামে কেউ অপকর্ম করতে না পারে। দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষায় আমরা মীর গ্রুপের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে যে গাড়ি সরানোর কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। কারণ মীর গ্রুপ বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের অনেক গাড়ি আছে। কার গাড়ি কে কোথায় নিচ্ছে- সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের ছিল না। আমরা শুধু চাঁদাবাজি বন্ধ এবং যে মোবাইল ফোন থেকে চাঁদা চেয়ে কল করা হয়েছিল, সেই নম্বরের ব্যক্তিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম।’
খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, যে মোবাইল নম্বর থেকে কল করে চাঁদা দাবির কথা বলা হচ্ছে সেটি বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে মীর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর আবদুস সালাম বলেন, ‘এনাম এবং আমি মামাতো-ফুপাতো ভাই। বিএনপি পরিচয়ে চাঁদা দাবির পর আমি এনামকে ফোন করে বলি, তোরা বিএনপির পরিচয় দিয়ে চাঁদা চাচ্ছিস, আয় চাঁদা নিয়ে যা। আমার এমন কথা শুনে এনাম এসে আমাকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এনামরা আসার আগেই আমি এস আলম গ্রুপকে অনুরোধ করেছিলাম, তারা যেন আমাদের গুদামে থাকা গাড়িগুলো সরিয়ে নেয়। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে তারা গাড়িগুলো আমাদের গুদাম থেকে বের করে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপি নেতারা যখন চাঁদাবাজি ঠেকাতে আমার গুদামে, তখন গাড়ি সরানোর কাজটি হচ্ছিল। দুটো কাজ একসঙ্গে হওয়ায় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এখন এনামসহ অন্যরা বিপদে পড়েছে।’
উল্লেখ্য, মীর আবদুস সালাম এবং সাইফুল আলম মাসুদ বেয়াই সম্পর্কের আত্মীয়। সালামের মেয়ের বিয়ে হয়েছে সাইফুল আলমের ছেলের সঙ্গে। আবার সালাম-এনাম মামাতো-ফুপাতো ভাই। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও তারা তিনজনই খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রিক ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট।
এতসব সম্পর্ক থাকায় এস আলমের সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করা এনামের জন্য বিপদের বিষয় কেন হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এনাম বলেন, এস আলমের সম্পদ রক্ষা আমার দায়িত্ব নয়। তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, সম্পর্কও নেই। আমি শুধু চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য গিয়েছিলাম।
এদিকে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন এস আলমের গুদাম রক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপি নেতা এস এম মামুন মিয়া বলেন, সরকার পতনের দিন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, কলকারখানা প্রায় সবখানেই দুর্বৃত্তরা নাশকতা চালাচ্ছিল। দেশের সম্পদ রক্ষায় আমি ওইদিন নেতাকর্মীদের নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। সেদিনের বাস্তবতায় সেটা খারাপ ছিল বলে মনে হয়নি। তবে এখন এস আলমের সম্পদের বিষয়ে রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ আছে। এখন বিএনপি এসবের মধ্যে নেই।’
মামুন নিজে মীর গ্রুপের গুদামে যাননি দাবি করে বলেন, আমাকে কেউ মীর গ্রুপের গুদামে দেখেছে, এটা বলতে পারবে না।
একই দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরে পটিয়ায় এস আলম হাউসের নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমকে পটিয়া পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক শাহজাহান চৌধুরী জানিয়েছিলেন, স্থানীয় লোকজনের বাধার কারণে এস আলম হাউসের মালামাল লুট হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে লুট হলে বিএনপির বদনাম হতো।
তিন নেতাকে বিএনপির শোকজ
এস আলম গ্রুপের ১৪ গাড়ি সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করার ঘটনায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে বিএনপি। নোটিস পাওয়া নেতারা হলেন- চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম মামুন মিয়া বলেন, আমি এখনও শোকজের কপি পাইনি। কপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না।