× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঘাবাড়ী বন্দর

খোলা আকাশের নিচে কয়েক হাজার টন ‘মানহীন’ সার, বিক্রি হচ্ছে গোপনে

সুজিত সরকার, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৬:৩৮ পিএম

আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৭:৩৭ পিএম

বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে কয়েক হাজার টন ‘মানহীন’ ইউরিয়া সার পড়ে আছে। বিক্রি করা হচ্ছে গোপনে। প্রবা ফটো

বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে কয়েক হাজার টন ‘মানহীন’ ইউরিয়া সার পড়ে আছে। বিক্রি করা হচ্ছে গোপনে। প্রবা ফটো

উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদীবন্দর হিসেবে খ্যাত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী বন্দর। এ বন্দরের সরকারি বিসিআইসির বাফার গোডাউনের পাশে উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টন ইউরিয়া সার। 

দীর্ঘদিন ধরে সারের বস্তাগুলো উন্মুক্ত স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় বৃষ্টিতে ভিজে ও রোদে পুড়ে এ সার শিলাপাথরের  মতো জমাট বেঁধে গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আনা এ সারের গুণমান নষ্ট হওয়ায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেনি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং বিসিআইসির সহকারী পরিচালক ও বাফার ইনচার্জের সহযোগীরা গোপনে ভালো সারের সাথে এ সকল মানহীন ইউরিয়া সার মিশ্র্রণ করে এখান থেকে অবৈধভাবে ডিলারদের কাছে শত শত টন সার বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুনগত মানহীন এ সকল ইউরিয়া সার কৃষকদের কাছে গেলে তাতে কৃষকের সর্বনাশ হবে। আর বদনাম হবে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া বিসিআইসির বাফার গুদামের সারের।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে শাহজাদপুর উপজেলায় বাঘাবাড়ী নদীবন্দর স্থাপন করা হয়। এটি যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এ বন্দর দিয়ে পেট্রোলিয়াম ডিপো থেকে পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য এবং সার সরবরাহের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বন্দরটি। কিন্তু সেই অর্থনীতির চাকার গতিরোধ করতে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ফসল ধান উৎপাদনের একমাত্র জৈব উপাদান ইউরিয়া সারকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। অসাধু ব্যক্তিরা খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখেছেন প্রায় কয়েক হাজার টন ইউরিয়া। এর মাধ্যমে দেশে ইউরিয়ার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। সময় বুঝে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা বেশি দামে সার বিক্রির জন্যই এমনটি করেছেন। 

সরজমিনে সম্প্রতি বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এলাকার বাফার গুদাম এবং বন্দর ইয়ার্ড ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০-২১ এবং ২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রামের মেসার্স নবাব ট্রেডিং কোম্পানির মাধ্যমে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে প্রায় ১২ হাজার টন ইউরিয়া সার আনা হয়। এসব সার সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার কৃষকদের বোরো মৌসুমে ভর্তুকিমূল্যে বিতরণের জন্য আমদানি করা। কিন্তু সারের গুণগতমান পরীক্ষার আগেই তা জমাট বাঁধায় বাফার গুদাম কর্তৃপক্ষ গ্রহণ না করে নবাব ট্রেডিংকে ফেরত দেয়। পরে ওই কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত সারগুলোকে নিলামে বিক্রির নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনও সেগুলো নিলামে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এদিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ এবং প্রতারণার মামলায় জড়িয়ে নবাব ট্রেডিংয়ের কর্ণধার বর্তমানে কারাগারে আছেন। এই সুযোগে বাঘাবাড়ী বন্দর কর্মকর্তা ও ইজারাদারের যোগসাজশে এসব জমাট বাধা সার হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো করে অন্য ভালো সারের সাথে মিশ্রণ করে নতুন করে প্যাকেট করে  উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কালোবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। মানের দিক থেকে খারাপ এসব সার কিনে গরিব ও প্রান্তিক কৃষক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

স্থানীয় আব্দুল সবুর নামে এক ব্যাক্তি বলেন, অনেক দিন ধরে এই সারগুলো বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখেছে। যেগুলো রোদে ও বৃষ্টিতে ভিজে গুণগতমান অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এই সারগুলো কৃষকের কাছে সরবরাহ করলে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আব্দুল কাদের নামে আরেকজন বলেন, বাঘাবাড়ী বন্দরে এই মানহীন সার অন্য সারের সাথে বস্তায় ভরে বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যক্তি যেগুলো উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছে। কৃষক এই সার জমিতে ব্যবহার করলে তাদের ফসলের ক্ষেতে কোনো উন্নতি হবে না।

বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের স্টক ইয়ার্ডের প্রবেশমুখে স্থানীয় রূপবাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মজিদের সাততলা ভবনের সামনেই পড়ে রয়েছে সারগুলো। আব্দুল মজিদ বন্দর ইজারাদারদের একজন। 

জানা গেছে, আব্দুল মজিদ নবাব ট্রেডিংয়ের কাছে টাকা পাবেন। এ টাকা আদায় করতে গোপনে সার বিক্রি করা হচ্ছে। বন্দর ইয়ার্ডের বেশিরভাগ স্থানজুড়ে সারগুলো রাখা আছে। এতে অন্যান্য সার পরিবহনের ট্রাক ভিড়তে পারছে না বন্দরে।

বন্দরের এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, বন্দরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সারগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও সময় সুযোগ বুঝে মঝেমধ্যেই রাতের আধারে গোপনে বিক্রি করা হয় সাব ডিলারদের কাছে। এর সঙ্গে শুধু বন্দর ইজারাদার নয়, এমন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জড়িত আছে। বন্দর ইয়ার্ডের বিশাল জায়গাজুড়ে পড়ে থাকা সারের প্রকৃত মালিক সবসময় অন্তরালে থাকেন। সে কারণে সারগুলো বিক্রিও হয় গোপনে। বোঝার উপায় নেই, কারা বিক্রি করছে, আর কারা কিনছে। বন্দর ঘাটের শ্রমিক নিয়ন্ত্রণকারী ইজারাদার আব্দুস সালাম এবং ঘাট নিয়ন্ত্রক শাহ-জামালকে বন্দর এলাকার অফিসে পাওয়া যায়নি। প্রতিবছর সাড়ে ৪ কোটি টাকায় ঘাট দুটি তারা ইজারা নেন। অভিযোগ আছে, ইজারা নেওয়ার পর থেকেই তারা বন্দরের পুরো জায়গা যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করতে থাকেন। তাদের সঙ্গে বন্দর কর্মকর্তার গোপন যোগসাজশ আছে বলেও অভিযোগ আছে।

বন্দরের জায়গায় কয়েক হাজার টন সার রাখা হয়েছে। এসব সারের ভাড়া বন্দর পায় কি না? এ বিষয়ে বন্দরে কাজ করা কয়েকজন শ্র্রমিক জানান, ইজারাদার এতগুলো টাকা দিয়ে ইজারা নেয়, অবশ্যই সার রাখার জন্য ইজারাদার ভাড়া পায়।

এ বিষয়ে জানতে বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরের ইজারাদার হাজী আব্দুস সালামের ফোনে একাধিকবার ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বাড়াবাড়ী বন্দরের সহকারী পরিচালক ও বাফার ইনচার্জ সিকান্দার আলী  বলেন, চারপাশে অনেক স্থানে খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘদিন থেকেই সার পড়ে আছে, সেসব আমাদের নয়। আমাদের মজুতকৃত ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার গুদামেই মজুত রয়েছে। প্রায় কয়েক বছর আগে নবাব ট্রেডিং ৩ হাজার টন ইউরিয়া সার বাঘাবাড়ীর বাফারে নিয়ে আসে। গুণগত মান নষ্ট হওয়ায় তা বুঝে নেওয়া হয়নি। তবে আমি কেন এগুলো বিক্রি করব আর আমার সাথে সালামের কোনো সম্পর্ক নেই ।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, বিসিআইসির সার ডিলার মোট ২৭১ জন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের আছেন ১১৪ জন। ৯টি উপজেলার মধ্যে ৬টির ডিলাররা এখান থেকে সার উত্তোলন করে থাকেন। বাকি ৩টি উপজেলার ডিলাররা যমুনা সার কারখানা থেকে সরাসরি সার উত্তোলন করে কৃষকদের মাঝে বিক্রি ও সরবরাহ করেন। আর আমরা সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার ২৭১ জন ডিলারকে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার এখান থেকেই দিয়ে থাকি।

শাহজাদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জেরিন আহমেদ বলেন, সিরাজগঞ্জ ও অন্যান্য জেলায় এসব সার বিক্রি করলে কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ওই সার যাতে কোনোভাবেই কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত না যায় এবং ক্ষেতে প্রয়োগ না করে, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এসব অপকর্মে বন্দর কর্তৃপক্ষের কেউ জড়িত থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানার পর সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে ফোন করেছিল বিষয়টি দ্রুত দেখার জন্য। বিসিআইসির একটি টিম সেখানে পরিদর্শন করছে তারা এখন পর্য়ন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। খুব শিগগিরই হয়তো ওই সারের ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেবে। কৃষকদের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জমাট বাঁধা ওই সার স্থানান্তর না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বাবুল কুমার সূত্রধর জানান, প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের হলরুমে সার-বীজ মনিটরিং বিষয়ে সভা হয়। বাঘাবাড়ী ওই সারের ব্যাপারে আমাদের অবগত করেননি। তবে গুণগতমান নষ্ট হওয়া সার ব্যবহার করলে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই সার ব্যবহারে সবাইকে সর্তক থাকতে হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা