ড. আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১৫:০৮ পিএম
ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ির বড়ুয়াপাড়া গ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত শুশুক। ছবি : ফারহান আহমেদ
হুটহাট সিদ্ধান্তে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ২০ আগস্ট রাতের বাসে চড়লাম কক্সবাজারের উদ্দেশে। পরদিন সকালে হোটেলে উঠেই চলে গেলাম সুইমিং পুলে। খানিক্ষণ সাঁতার কেটে বেরিয়ে পড়লাম রেডিয়্যান্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড দেখার জন্য। বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, শামুক-ঝিনুক ও প্রাণীর সংগ্রহ রয়েছে ওখানে। যদিও মেলবোর্ন, সিডনি বা কুয়ালালামপুরের অ্যাকুয়ারিয়ামগুলোর তুলনায় ততটা উন্নত নয়, কিন্তু জনসাধারণকে সামুদ্রিক প্রাণী চেনাতে যথেষ্টই সমৃদ্ধ। বিকালে কলাতলী সমুদ্রসৈকতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরতি বাসের টিকিট কাটলাম।
দুঃসংবাদটা পেলাম রাতের খাবারের সময়। ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের স্লুইসগেট খুলে যাওয়ায় গোমতী, ফেনী, মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে আশপাশের এলাকা দ্রুত প্লাবিত হচ্ছে। কক্সবাজারেও সারা রাত বৃষ্টি। সকালে ঢাকা ফেরার বাস। কাউন্টারে যোগাযোগ করতেই ওরা জানালেন সমস্যা নেই। ঢাকা থেকে বাস ঠিক সময়েই এসেছে। কাজেই ফিরতি বাসে উঠলাম। বেলা ১১টায় রওনা দিয়ে সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। দোহাজারী আসার পর বৃষ্টি থামল, আবহাওয়া চমৎকার, ঝলমলে রোদ। চট্টগ্রাম থেকে বাস ছাড়ল বিকাল ৪টায়। ভাটিয়ারী ও সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রচুর স্পিডবোট, ইঞ্জিন বোট ও সাম্পান ট্রাকে তুলতে দেখলাম। সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী ও বন্যার্তদের উদ্ধারে তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর দল। তাদের উৎসাহ, উদ্যম ও সহমর্মিতা দেখে ভালো লাগল। বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ মিরেরসরাইয়ের বারৈয়ারহাটে কিছুটা জ্যাম পেলাম। এরপর বাস ধীরে ধীরে চলতে লাগল।
সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল পৌঁছলাম। ঢাকামুখী লেনে পানি না উঠলেও চট্টগ্রামমুখী লেনের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠেছে। রাস্তার আশপাশের বাড়িঘর ও দোকানপাটে কমবেশি বুকপানি। স্থানীয় জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবীরা বন্যাপীড়িত লোকজন, তাদের জিনিসপত্র ও গবাদিপ্রাণী উদ্ধার করে আশপাশের উঁচু স্থান ও রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারে জড়ো করছেন। উদ্ধারকাজে কিছু সেনাসদস্যকে দেখলেও পুলিশ বা আনসারদের চোখে পড়লও না।
ধীরে ধীরে গাড়ি সামনে এগোচ্ছে। একসময় এমন অবস্থা হলো যে, ২ মিনিট গাড়ি চললে ১০ মিনিট থেমে থাকে। দুই লেনের রাস্তায় তিন লেনে গাড়ি চলতে লাগল। একসময় চট্টগ্রামমুখী গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড যানজটে স্পিডবোট-নৌকা বহনকারী ট্রাকলরিগুলো থেকে নৌকা নামানো দুরূহ হয়ে পড়ল। এরকম দুর্যোগের সময় পরিবহন কোম্পানিগুলোর উচিত গাড়ি বন্ধ রাখা। অথচ তারা তা করছেই না, বরং চট্টগ্রামের দিক থেকে প্রচুর বাস-ট্রাক আসছে তো আসছেই। এদিকে বন্যার পানির উচ্চতা ও স্রোত দুটোই বাড়তে লাগল। রাস্তা অনেক জায়গায় ডুবে যেতে থাকল। ফলে উদ্ধারকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হলো। কাজেই ঘোপাল থেকে মুহুরী সেতু, মুহুরীগঞ্জ, ফাজিলপুর, কস্কাবাজার ও সিলোনিয়া সেতু পাড়ি দিয়ে লেমুয়া বাজারের কাছে একটি পার্টি সেন্টার পর্যন্ত ৯ কিলোপথ পাড়ি দিতে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লেগে গেল। এরপর আর গাড়ি এগোতে পারল না।
লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ৩-৫ দিনেও গাড়ি এখান থেকে সরতে পারবে না। কাজেই বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীরা হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমাদের বাসে মহিলা ও শিশুর সংখ্যা বেশি থাকায় আমরা চট্টগ্রাম ফেরত যাওয়ার জন্য ড্রাইভার ও গাইডকে অনুরোধ করলাম। একদিকে বন্যার পানি বাড়ছে, অন্যদিকে এমন এক জায়গায় থেমে আছি; যেখানে বিদ্যুৎ, মোবাইল ও ইন্টারনেট নেই। খাদ্য ও পানিরও অভাব। অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লাম। এভাবেই পুরোটা রাত বাসের মধ্যে কাটাতে হলো।
সারা রাত ঘুম হলো না। বাস থেকে নেমে পাশের পার্টি সেন্টারে গেলাম। বন্যার্ত অসহায় মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার মানুষের সংখ্যা বাড়লেও ওখানে কোনো গবাদি বা বন্য প্রাণী দেখলাম না।
ফজরের ওয়াক্ত থেকেই আমিসহ অন্য যাত্রীরা চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার ও গাইডকে অনুরোধ করতে থাকলাম। তখনও বন্যার পানি আমাদের থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ পানি বাসের সামনে চলে এলো। শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার মামুন সাহেব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেন। ৮টা নাগাদ আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলাম। তবে বন্যার পানির উচ্চতা ও স্রোত বাড়া, প্রচণ্ড যানজট ও বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাকলরি থেকে নৌকা-স্পিডবোট নামানোর কারণে লেমুয়া থেকে মিরেরসরাই পর্যন্ত ২৮ কিলোপথ পাড়ি দিতে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাগল। অবশেষে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম বেলা সোয়া ৩টায়।
আগের রাতে অন্ধকারের কারণে বন্যা পরিস্থিতি ভালোভাবে দেখতে পারিনি; সকালের আলোয় তার ভয়াবহতার প্রকৃত রূপ দেখলাম। একদিকে বন্যাদুর্গত মানুষের কষ্ট ও আহাজারি, অন্যদিকে খাদ্য-পানি ও টয়লেটের অভাবে রাস্তার বাসযাত্রীদের অসহায় অবস্থা দেখে অত্যন্ত খারাপ লাগছিল।
প্রচণ্ড যানজটের কারণে আধা ঘণ্টা বাস চলার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টা আটকে থাকলাম। আমাদের বাসের কয়েকজন তরুণযাত্রী এ সময় নৌকা নামাতে উদ্ধারকারীদের সাহায্য করল। ইচ্ছে থাকলেও পায়ের সমস্যার কারণে একাজের অংশীদার হতে পারলাম না। তবে আশপাশটা ঘুরে দেখতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশকিছু পোল্ট্রি খামার পুরোপুরি পানির নিচে। একটি খামারের মুরগিগুলো উচ্চস্বরে ডাকছিল। ওদের ডাক এতটাই করুণ ছিল যে আমার মেয়ে বলল, ‘আব্বু, এভাবে কারা কাঁদছে?’ আমি বললাম, ‘ওরা মানুষ নয়, মুরগি।’ হোক না ওরা মুরগি, ওদেরও তো প্রাণ আছে, ওরাও তো বাঁচতে চায়। খামারে কোনো লোকজন দেখলাম না। নিজেদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে হয়তো তারা মুরগিগুলোর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।
বাস যেখানে আটকে ছিল সেখানে হাঁটুপানি। অবিরাম বৃষ্টি। রাস্তার পাশের জমিগুলো এখন বিস্তৃর্ণ প্লাবিত ভূমি। খানিকটা দূরে কয়েকটি ডুবন্ত বাড়ি। উদ্ধারকর্মীরা নৌকা ও স্পিডবোট নিয়ে বন্যার্তদের খুঁজছেন। রাস্তার পাশের গাছটিতে একটি ফিঙে ভিজে চুপচুপ হয়ে বসে আছে। বৃষ্টিতে ওর খাদ্য কীটপতঙ্গের দেখা মিলছে না। হঠাৎ একটি বাচ্চা সাপ দ্রুতগতিতে এসে পাশের গাছে আশ্রয় নিল। চার-পাঁচটি শালিক পুরোপুরি ভিজে ডুবন্ত একটি বাড়ির দোতলার কার্নিশে আশ্রয় নিয়েছে। কিছুটা দূরে একটি অর্ধ-ডুবন্ত একতলা বাড়ির পাশের গাছে তিনটি পানকৌড়ি ও ক’টি বক বসে আছে। একটি ভুবন চিল মাছ শিকার ব্যস্ত। যদিও বন্যায় মানুষের মতো অবলা বোবা প্রাণীগুলোরও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য বন্য প্রাণীর তুলনায় পাখিরা কিছুটা ভালো আছে। ডানা থাকায় ওরা উড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারছে। তবে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে খাদ্য সমস্যায় পড়ছে কীটপতঙ্গভুক পাখিরা।
আশপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর যে-ই না বাসে উঠেছি, অমনি দেখলাম কয়েকজন লোক লাঠি দিয়ে পানিতে ভেসে আসা একটি সাপকে মারছে। ওদের থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। যদিও সাপটি নির্বিষ ছিল, কিন্তু ভীতির কারণে ওরা সাপটিকে মেরে ফেলল। বেচারা সাপ প্রাণ বাঁচাতে পানি থেকে ডাঙায় উঠে মারা পড়ল।
যদিও হঠাৎ বন্যায় মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গেছে, আহতও হয়েছে অনেকেই। তবে তাদের উদ্ধারে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী এসেছে। তারা মানুষের পাশাপাশি গবাদি প্রাণীও উদ্ধার করছে। কিন্তু কুকুর-বিড়াল ও বন্য প্রাণী উদ্ধার হচ্ছে নগণ্য সংখ্যক। গবাদি প্রাণীর মতো পোষা ও বন্য প্রাণীরাও এদেশের সম্পদ। কাজেই মানুষ ও গবাদি প্রাণী রক্ষার পাশাপাশি ওদেরও রক্ষা করা জরুরি। তা না হলে দেশের প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে, পরিবেশ হারাবে ভারসাম্য। বন্যায় বিভিন্ন প্রজাতির বন্য ও পোষা প্রাণীর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বেশি অসহায়। কারণ ওরা এই স্রোতপূর্ণ পানিতে বেশিক্ষণ সাঁতার কেটে বাঁচতে পারে না। একটি ফেসবুক পোস্টে দেখলাম বন্যার কবল থেকে বাঁচতে একটি ইঁদুর ছোট্ট একটি গাছে আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো আরেকটু পানি বাড়লেই ইঁদুরটি ভেসে যাবে বন্যার পানিতে।
আমার ছাত্র চট্টগ্রামের প্রাণিচিকিৎসক ডা. সাদ্দাম হোসেন মারফত জানতে পারলাম বন্যার পানিতে হালদা নদী থেকে একটি শুশুক ভেসে এসেছে ফটিকছড়ির নাজিরহাটে। সঙ্গে সঙ্গে হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের গাইড মো. নাহিদুল ইসলামকে ফোন দিলাম। সে সত্যতা স্বীকার করে জানাল, ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া গ্রামে ডলফিনটিকে জালে আটকে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন এটিকে জালমুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছেন।
এই আকস্মিক বন্যায় বন্য প্রাণী উদ্ধারের তেমন একটা খবর জানা যায়নি। অতিরিক্ত স্রোত উদ্ধারকাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পানি নেমে যাওয়ার পর মানুষের মতো গবাদি, পোষা ও বন্য প্রাণীরাও নানা রোগ ও খাদ্যাভাবে পড়বে। অতএব, এদিকটায় আমাদেরও লক্ষ রাখতে হবে। সামাজিক ও পত্রিকা মারফত জানা গেছে মানুষের পাশাপাশি প্রাণীদেরও খাবারের ব্যবস্থা করছে আস সুন্নাহ ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এবং বিভিন্ন ব্যক্তি। এ ছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বন্যাদুর্গত এলাকার প্রাণিসেবায় নিয়োজিত। বন বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটও বন্য প্রাণীর সেবা দিতে প্রস্তুত। তা ছাড়া অল্প কিছু বন্য প্রাণী উদ্ধারকারী সংগঠন ক্ষুদ্র পরিসরে পীড়িত প্রাণীদের রক্ষা করছে।
বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ও ইন্টার্ন ছাত্ররা কুমিল্লা ও ফেনীর বন্যা উপদ্রুত এলাকায় প্রাণীদের সেবা দিচ্ছেন। আমি তাদের অনুরোধ করেছি গবাদির পাশাপাশি আক্রান্ত বন্য প্রাণীদেরও উদ্ধার এবং চিকিৎসা প্রদানের জন্য। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক ও ইন্টার্ন ছাত্ররা বন্যাপরবর্তী গবাদি ও বন্য প্রাণীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। আশা করি, এদেশের ছাত্রসমাজ, তরুণ ও আপামর জনসাধারণ বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগের সময় মানুষ ও গবাদি প্রাণীর পাশাপাশি বন্য প্রাণীদেরও উদ্ধার করবে; তাদের খাদ্য, চিকিৎসাসেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেবে।