হুমায়ুন মাসুদ ও হাসিব আল আমিন, নোয়াখালী থেকে
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১০:৫৪ এএম
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৪ ১১:০৬ এএম
ভয়াবহ বন্যায় পানির টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় বন্যা কবলিত এলাকায় সংকট তৈরি হয়েছে সুপেয় পানির। ছবিটি বৃহস্পতিবার রোয়াখালী সদর এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
‘যারা বন্যার পানিতে নামছেন, তাদের সবার পায়ের অবস্থা খারাপ। বন্যার পানি শরীরের যেখানে লাগছে সেখানেই চুলকাচ্ছে। পায়ের পাতায় ক্ষত তৈরি হচ্ছে। এই দেখেন আমার পায়ে কতগুলো ক্ষত তৈরি হয়েছে।’ বন্যায় পানিবন্দি এলাকায় চর্মরোগ বেড়ে গেছে জানিয়ে ওপরের কথাগুলো বলেছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন। বন্যায় তাদের এলাকায় চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ বেড়ে গেছে বলে জানান সাবেক এই জনপ্রতিনিধি।
কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বন্যায় ঘরবাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে একদিকে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে এলাকায় ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগ বেড়ে গেছে। যারাই বন্যার পানিতে হাঁটাচলা করছেন, তাদের প্রত্যেকের শরীরে এখন চুলকানি দেখা দিচ্ছে।’
শুধু একলাশপুর নয়, একই অবস্থা এখন নোয়াখালী জেলার অধিকাংশ পানিবন্দি এলাকায়। যেসব এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে আছে। সবখানে এখন ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগ। বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং সেপটিক ট্যাংকের ময়লা-আবর্জনা পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় পানিবাহিত রোগে ভুগছে পানিবন্দি এলাকার বাসিন্দারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর, শরীফপুর, মুরাদপুর, খানপুর, বাবুনগর, হাজীপুর, আলীপুর, দরবেশপুর, কাজীনগর, জয়কৃষ্ণপুরসহ অধিকাংশ এলাকা ঘুরে দেখা যায়- এসব এলাকার ঘরবাড়ি এখনও কোমরসমান পানির নিচে। নৌকাই এখন যাতায়াতের মাধ্যম। নৌকায় চড়ে একলাশপুর বাজার থেকে পূর্ব একলাশপুর পাটোয়ারী সড়ক হয়ে শরীফপুর যাওয়ার পথে দেখা যায়, ওই সড়কের অধিকাংশ এলাকায় কোমরসমান পানি। ডিসি রোড হয়ে ফিরতি পথেও দেখা গেছে একই অবস্থা। সড়কের পাশের ঘরবাড়িগুলোতে কোমরসমান পানি। যে কারণে ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। টয়লেট, বাথরুমগুলোও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ছে বন্যার পানিতে।
স্থানীয়রা জানান, ওইসব এলাকায় গত বুধবার আরও বেশি পানি ছিল। গতকাল সকাল থেকে রোদ থাকায় পানি কিছুটা কমছে। গতকালের তুলনায় আজ (বৃহস্পতিবার) ৫-৬ ইঞ্চি পানি কমেছে বলে তারা জানান। রোদ থাকায় পানি কিছুটা কমতে থাকলেও এলাকাবাসী এখন চর্মরোগসহ ডায়রিয়ায় ভুগছে।
পূর্ব একলাশপুর গ্রামের কোরবান আলী হাজীবাড়ির বাসিন্দা সাবেক সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রব বলেন, বন্যায় বাসাবাড়ির সেপটিক ট্যাংকগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মলমূত্রগুলো এখন পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই দূষিত পানি মানুষের শরীরে লাগলেই চুলকানিসহ নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে কিছু কিছু এলাকায় মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
একই অবস্থা নোয়াখালী সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, কোম্পানীগঞ্জ, চাটখিল উপজেলায়। ওইসব উপজেলার অধিকাংশ এলাকা এখনও হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে আছে। গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনও হাঁটুসমান পানি। সদর উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে আছে। চৌমুহনী চৌরাস্তা হয়ে সোনাইমুড়ী যাওয়ার পথে দেখা যায়, চৌরাস্তা সড়কের ওপর গোড়ালিসমান পানি রয়েছে। ওই রাস্তার দুই পাশের ঘরবাড়িগুলো এখনও পানির নিচে।
সরকারি হিসাবে চলমান বন্যায় নোয়াখালীর আট উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের ২০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। বন্যায় যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে, ওইসব এলাকা দীর্ঘদিন জলমগ্ন হয়ে থাকায় সেসব এলাকায় এখন সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত এই দুটি কারণে বন্যাকবলিত এলাকায় এখন চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তারা বলছেন, যে এলাকায় বন্যা হয়। সেখানে বন্যা-পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। এবার যেহেতু নোয়াখালীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। তাই পানিবন্দি এলাকায় এখন পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়বে। ত্রাণসহায়তা প্রদানের পাশাপাশি এখন প্রশাসনকে পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় কাজ করতে হবে।
নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ পর্যন্ত গত কয়েক দিনে ১৩০ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চর্মরোগীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ডায়রিয়ার প্রকোপ যাতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য আমরা বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। চর্মরোগে আক্রান্তদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
একই সময়ে নোয়াখালী জেলায় সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘নোয়াখালীতে এখন সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েক দিনে ১২২ জন সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।’