আবু রায়হান তানিন ও ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী ঘুরে এসে
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪ ১১:০৪ এএম
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪ ১৭:৪১ পিএম
ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে পড়েছে ঘর। পানি নামার পর খোলা আকাশের নিচে কর্দমাক্ত উঠোনে বসে শুকনো খাবার খাচ্ছে দুই ভাই। রবিবার চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি বাগানবাজার ইউনিয়নের আন্ধারমানিক গ্রামের। প্রবা ফটো
‘বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হালদায় পানি বাড়ছিল। এই অংশে কোনো বেড়িবাঁধ নেই। একদম নদীর পাড়ে আমার ঘর। এই ঘর ছাড়া আর কোনো সম্পদ নাই। ফজরের নামাজের পর থেকে তাই বস্তায় মাটি ভরে নদীর পাড়ে বাঁধ দিচ্ছিলাম। সারাদিন ২০০ বস্তার মতো মাটি দিলাম। কিন্তু কিছুতে কিছু হলো না। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সেই বাঁধ ভেঙে ঘরটা ধসে গেল চোখের সামনে।’
ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট নতুন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে এভাবেই বন্যায় নিজের সব হারানোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন হাটহাজারীর পূর্ব ফরহাদাবাদের সিএনজিচালক দিদার আলম। ব্রিজের পূর্ব পাশে ফটিকছড়ি আর পশ্চিমে হাটহাজারী। বন্যার প্রথম ধাক্কায় ঘর হারানো দিদারের পরিবার তিন সদস্যের। পাশের ঘরটা তার ভাইয়ের। ওই পরিবারের সদস্য ১৪ জন। তাদের ঘরও ধসে পড়েছে। সব হারিয়ে ফটিকছড়ির একটি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন তারা।
বাগানবাজার ইউনিয়নের আন্ধারমানিক বল্টুরাম টিলার বাসিন্দা অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ সালমা বেগম অবস্থা আরও খারাপ। গতকাল রবিবার দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে পড়া ঘরের সামনে একটি টিন পেতে বসে দুই সন্তানকে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছর দেড়েক আগে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ঘরটি দিয়েছিলেন তিনি। ঋণ শোধ না হতেই বন্যার পানিতে তার সেই ঘর ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ‘গত চার দিন ধরে অন্যের ঘরে থাকছি। কোনো ঘরে চুলা জ্বালানোর অবস্থা নেই। শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি।’
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় শুধু ফটিকছড়িতেই ৬০০ ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজারের মতো ঘর। তবে পানি না কমায় এখনও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের তালিকা করতে পারেনি হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। দুই উপজেলায় নিহতের সংখ্যা ৫ জন।
এর আগে নাজিরহাট নতুন ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম অংশে ঘুরে দেখা যায়, হালদার পাড়ের প্রায় ১০০ মিটার এলাকা ভেঙে গেছে। পাশে দুটি টিনের ঘর ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্লকের খণ্ডাংশ। ওই ঘর দুটোই দিদার ও তার ভাই সমশুর। স্থানীয় বাসিন্দা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হালদার তীর রক্ষায় ব্লক বাঁধ দেওয়া হলেও হালদাপাড়ে কোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বাঁধের বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এর ফলেই হালদায় পানি বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে কমপক্ষে ২২টি পয়েন্টে তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে দুই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, হাটহাজারীর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘হালদায় তীর রক্ষা বাঁধ থাকলেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। ২০২১ সালে একটা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্প করার চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কারণ তৎকালীন সরকারের নীতি ছিল ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে এমন কোনো প্রকল্প পাস হবে না। আর স্থানীয় বাসিন্দারাও অধিগ্রহণ ছাড়া এমনিতে জমি দিতে রাজি হয়নি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিএনজিচালক দিদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেড়িবাঁধ হোক তা আমরাও চাই। কিন্তু বিনামূল্যে ভিটা দিয়ে দিলে যাব কই? এই একটা ভিটা ছাড়া তো আমার কিছু নাই। আমরা বলেছি, আমাদের ক্ষতিপূরণ দিক। এখন তো আবার ভিটায় ঘর দিতে পারব। বাঁধের জন্য জমি ছেড়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ না পেলে ঘর দেওয়ার জায়গা পাব কই?’
ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করতে না পারার মাশুল গুনতে হচ্ছে হালদার দুই পাড়ের ফরহাদাবাদ, সুয়াবিল, সুন্দরপুর, পাইন্দং, কাজীরহাট, নারায়ণহাট, ভূজপূরসহ বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষকে। নিজেরা তো পানিবন্দি হয়েই আছেন, উপরন্তু পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে জমির ফসলও।
কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও সুয়াবিল ও ফরহাদাবাদের মানুষ এখনও পানিবন্দি। অন্যদিকে পানি নেমে যাওয়া এলাকাগুলোতে দেখা গেছে মানুষজন ঘরের ভেতর জমে থাকা পলি সরানোর কাজ করছে। বেশিরভাগ ঘরের ভেতরেই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠেছিল। তেমনই একজন সুন্দরপুরের নুরজাহান বেগম। ৭০ বছর বয়সি এই বৃদ্ধা তার স্বামীকে নিয়ে মাটির একটি ঘরে থাকেন। পাশেই তিনটি দোতলা ভবন রয়েছে প্রতিবেশীদের। শনিবার বিকালে যখন তার সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি ঘরের ভেতরটা পরিষ্কার করছিলেন। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ পানি ওঠায় স্বামীকে পাশের ঘরে রেখে আসি। তারা দুই দিন তাকে রাখছে, খাওয়াইছে। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। ঘরে যা ছিল সব মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না।’
বন্যায় সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ফটিকছড়ি উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী বন্যায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ৬০০ ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজারের মতো ঘর। তবে পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির তালিকা এখনও করা সম্ভব হয়নি। এখনও অনেক এলাকায় পানি নামেনি। ত্রাণ কার্যক্রমই আমরা শেষ করতে পারিনি।’
হাটহাজারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, হাটহাজারীতে এখনও পানি নামেনি। তাই ক্ষয়ক্ষতির কোনো তালিকাও করা সম্ভব হয়নি। এ উপজেলায় বন্যার কারণে একজনের মৃত্যু হয়েছে।